বাস ও লঞ্চ

‘খুশিমতো’ বাড়িয়ে নিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়

সরকার যে ভাড়া ঠিক করেছে, তাতে মালিকদের ‘লাভ হয়েছে’। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে নিজেদের ‘ইচ্ছেমতো’ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

ভাড়া বাড়িয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে তিন দিনের পরিবহন ধর্মঘট। তাই বেশি ভাড়া দিয়েই বাসে চলতে হয়েছে যাত্রীদের। গতকাল বিকেলে অফিস ছুটির পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড়ে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন পরিবহনমালিকেরা। ভাড়া নির্ধারণের বৈঠকে বাড়ানোর হারটি ঠিক হয়েছে তাঁদের অনুকূলে। পরে মাঠপর্যায়ে নিজেদের সুবিধামতো ভাড়া নির্ধারণ করেছেন তাঁরা।

শুধু বাস নয়, সুবিধা হয়েছে লঞ্চমালিকদেরও। সরকারিভাবে লঞ্চে গড়ে ভাড়া বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। কিন্তু ভাড়া এমন কৌশলে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে কার্যত বাড়বে ৪৩ শতাংশের বেশি। কারণ হলো, বেশি দূরত্বে বেশি হারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সাধারণত স্বল্প দূরত্বে বেশি হারে ভাড়া বাড়ানো হয়।

সরকার গত বুধবার দিবাগত রাতে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে। গত রোববার নতুন ভাড়া নির্ধারিত হয়। কার্যকর হয় গতকাল সোমবার থেকে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের ভর্তুকি চাপ কমবে। মালিকেরা বাড়তি ভাড়া আদায় করে বাড়তি মুনাফা করবেন। শুধু বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। হঠাৎ করেই যাতায়াতে অনেকটা বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে তাঁদের। নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে কষ্টে থাকা মানুষের জন্য বড় চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে পরিবহন খরচ।

পরিবহনমালিকেরা ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে আজগুবি ব্যয় দেখিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নেন। এরপর রাস্তায় যাত্রীদের কাছ থেকে আরও বেশি আদায় করেন।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহাসচিব, যাত্রী কল্যাণ সমিতি

পণ্য পরিবহনকারী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও অন্যান্য যানবাহনের মালিকেরা ডিজেলের দাম কমানোর দাবি করেছিলেন। তা পূরণ হয়নি। গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠকের পর তাঁরা ধর্মঘট স্থগিত করেন। উল্লেখ্য, পণ্যবাহী যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণ করেন মালিকেরাই।

রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতি কিলোমিটারে মিনিবাসের ভাড়া বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। আর বড় বাসের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ শতাংশের মতো। আর দুই ধরনের বাসেই সর্বনিম্ন ভাড়া বেড়েছে তিন টাকা করে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পরিবহন খাত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই ভাড়ার হার নির্ধারণে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। এতে পরিবহনমালিকেরা বড় ধরনের সুবিধা পেয়েছেন।

২০১৬ সালে ঢাকার জন্য করা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার মানুষ বাস-মিনিবাসে যত যাতায়াত করে, তার ৪০ শতাংশই কম দূরত্বের পথে, তিন কিলোমিটারের মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ নগরী চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও একই ফল হওয়ার কথা। অথচ ঢাকা ও চট্টগ্রামে সর্বনিম্ন ভাড়াই সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। ঢাকায় মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৭১ শতাংশ। বড় বাসের ক্ষেত্রে তা ৪৩ শতাংশ।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর গত রোববার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে ভাড়া নির্ধারণের যে বৈঠক হয়, তাতে পরিবহনমালিক নেতাদেরই আধিক্য ছিল বেশি। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া বিআরটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে সুবিধামতো ভাড়া নির্ধারণে তৎপর ছিলেন মালিকেরা। এরপর মাঠপর্যায়ে আরেক দফা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

সরেজমিনে গতকাল ঢাকার বাসে চলাচল করে দেখা যায়, মিনিবাসের জন্য সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। আর বড় বাসে ১০ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ‘সিটিং সার্ভিস’ নাম দিয়ে চলাচলকারী কোনো কোনো বাস সর্বনিম্ন ভাড়া হিসেবে ১৫ টাকা বা এরও বেশি আদায় করেছে।

আবদুস সালাম নামের একজন যাত্রী গতকাল সকাল পৌনে নয়টার দিকে বিকল্প পরিবহনের একটি মিনিবাসে ওঠেন ফার্মগেট থেকে। নামবেন বেগম রোকেয়া সরণির তালতলায়। তাঁর কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয় ২০ টাকা। বিআরটিএর হিসাবে, এই পথের দূরত্ব পৌনে চার কিলোমিটার। ভাড়া আট টাকা হওয়ার কথা। একপর্যায়ে যাত্রীরা হইচই শুরু করলে চালকের সহকারী নূরে আলম বলেন, ‘আঙ্গরে কইয়া লাভ নাই। আমরা একজনের চাকরি করি।’

বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, কোনো গণপরিবহনের মালিক, চালক, কন্ডাক্টর, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করতে পারবে না। এই আইন অমান্যের দায়ে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে রজনীগন্ধা পরিবহনের একটি বাসকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার বিস্তৃত পরিসরে অভিযান চালানো হবে।

এদিকে আজ থেকে বাসে ভাড়ার পূর্ণাঙ্গ তালিকা টানানো হবে বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এরপরও কেউ বাড়তি আদায় করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

ব্যয় বিশ্লেষণে ‘গোঁজামিল’

বিআরটিএ ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস-মিনিবাসের ১২টি বিষয় ও বিনিয়োগ বিবেচনা করে। এর মধ্যে বাস কেনা, এর আয়ুষ্কাল, যাত্রী আসন ও আসন অনুযায়ী যাত্রী পাওয়ার হার বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ ছাড়া জ্বালানিসহ পরিচালন ব্যয়ের খাত বিবেচনায় নেওয়া হয় কমবেশি ২০টি।

সর্বশেষ গত রোববার নির্ধারণ করা ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দূরপাল্লা ও রাজধানীতে চলাচল করা বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০ বছর। তবে ঢাকায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত বাস চলতে দেওয়া হয়। দূরপাল্লার বাসে এ–সংক্রান্ত কোনো সীমা নেই। ঢাকার বেশির ভাগ বাস লক্কড়ঝক্কড় এবং দূরপাল্লায় পুরোনো বাসই বেশি।

ব্যয় নির্ধারণে রাজধানীর বাসে চালকের বেতন ১ হাজার টাকা এবং সহকারী দুজনের বেতন যথাক্রমে ৭০০ ও ৪০০ টাকা ধরা হয়। এ ছাড়া বছরে তাঁদের দুবার উৎসব ভাতা বা বোনাস ধরা হয় ৪০ হাজার টাকা। যদিও ঢাকার বেশির ভাগ মালিক দিনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার শর্তে বাস চালক-শ্রমিকদের কাছে দিয়ে দেন। উৎসব ভাতা দেওয়ার রেওয়াজই নেই।

ব্যয় নির্ধারণে বাসের সাজসজ্জার ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ বছরে এক দফায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা। যদিও ঢাকার অধিকাংশ বাসই রংচটা, জীর্ণ। ঢাকার বাস প্রতি লিটার ডিজেলে আড়াই কিলোমিটার এবং দূরপাল্লার পথে সাড়ে তিন কিলোমিটার চলে ধরে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ কোনো দিন একটি বাসে কী পরিমাণ জ্বালানি ব্যয় হয়, তার কোনো সমীক্ষা করেনি।

মালিকেরা বলছেন, নতুন করে যে ভাড়া ধরা হয়েছে, তাতে জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্যের ব্যয় উঠবে। অন্যান্য ব্যয় ভালোভাবে ধরলে ভাড়া আরও বেশি হতো। অবশ্য যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবারই পরিবহনমালিকেরা ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে আজগুবি ব্যয় দেখিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নেন। এরপর রাস্তায় যাত্রীদের কাছ থেকে আরও বেশি আদায় করেন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি।