খুনের চার মামলা থেকেও রেহাই পান ‘মাছ কাদের’

কাদের আবার আলোচনায় এসেছেন নির্বাচনী সহিংসতার খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে। এর আগে খালাস পেয়েছেন আরও ২৩ মামলায়।

আবদুল কাদের

র‍্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন। আসামি ছিলেন ২৮ মামলায়। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হয়েছে চারটি খুনের মামলা। ভয়ে সাক্ষীরা মুখ না খোলায় খালাস পান খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও অস্ত্র আইনের আরও ২৩ মামলায়। রাজনীতির ছায়ায় বেড়ে ওঠা এই ব্যক্তির নাম আবদুল কাদের। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আগ্রাবাদের ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর তিনি। নগর রাজনীতিতে তিনি সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

আবদুল কাদের আবার আলোচনায় এসেছেন নির্বাচনী সহিংসতার খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে। এবারের সিটি নির্বাচনে দল থেকে সমর্থন না পেয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। প্রচারণা শুরুর পাঁচ দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার রাতে তাঁর এলাকা পাঠানটুলীর মগপুকুরপাড় এলাকায় দল মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় তাঁর অনুসারীদের। এতে আজগর আলী ওরফে বাবুল নামের এক মহল্লা সরদার নিহত হন। আজগর ছিলেন বাহাদুরের সমর্থক। আজগরের পরিবার ও প্রার্থী বাহাদুরের দাবি, বাহাদুরের পক্ষে কাজ করায় পরিকল্পিতভাবে আজগরকে হত্যা করা হয়েছে। এমন সহিংসতায় শঙ্কায় আছেন কাদেরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও এলাকার মানুষেরা।

রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার হওয়ায় সমাজে অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে। সরকারি দলে যাঁরা এসব সন্ত্রাসীর পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নইলে অপরাধ বাড়তে থাকবে।
আখতার কবির চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক

নগরের মোগলটুলী বাজারে ছোটবেলা থেকে মাছের ব্যবসা করতেন। সে কারণে ‘মাছ কাদের’ হিসেবে পরিচিতি তাঁর। ২০০০ সালের ১ এপ্রিল গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৮ এপ্রিল কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ২০১৫ সালে পাঠানটুলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

পাঠানটুলীতে এবার দলের সমর্থন পেয়েছেন ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম বাহাদুর। তিনি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কাদেরের আগে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন তিনি।

নজরুল ইসলাম বাহাদুর প্রথম আলোকে বলেন, কাদের তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এলাকায় তাঁর ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না।

নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ইনামুল হক দানু, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কাদেরের নাম মামলা থেকে প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করেন।

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, কাদেরের তুলনায় বাহাদুরের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ। তাই পরিচ্ছন্ন এই রাজনীতিবিদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কাদেরের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ রয়েছে।

আদালত সূত্র জানায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অব্যাহতি পাওয়া খুনের মামলা চারটি হলো ১৯৯৭ সালে সিটি কলেজছাত্র শফি উদ্দিন আজাদ হত্যা, ১৯৯৮ সালে ডবলমুরিং থানার ব্যবসায়ী আবদুল কাদের, ১৯৯৯ সালে নগরের পাঁচলাইশ থানার পলিটেকনিকের ছাত্র আবদুল কাদের হত্যা ও ২০০০ সালে আরেক ব্যবসায়ী আহাম্মদ আলী হত্যা। প্রতিটি মামলায় সাক্ষীরা খুনের ঘটনায় কাদের জড়িত বলে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে ব্যবসায়ী কাদের হত্যা মামলা ছাড়া বাকি ২৬টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এতে অন্য আসামিরাও খালাস পান। তবে কাদেরের বিরুদ্ধে অপহরণের একটি মামলায় ১০ বছরের সাজা হলেও তিনি আপিল করেন।

বিচারাধীন কাদের হত্যা মামলার বাদী ও নিহতের বড় ভাই নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিচার শেষ হওয়ার আগেই গুলিবর্ষণকারী কাদের মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। কার বিচার হবে।’ এই মামলা সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি।

২০১৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কাদেরের বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলায় অব্যাহতির জন্য আদালতে আবেদন করেছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর তৎকালীন সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কামাল উদ্দিন। এখন তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। পরের বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শুনানি শেষে বিচারক কাদেরের নাম প্রত্যাহারের আদেশ দেন। জানতে চাইলে কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা থেকে প্রত্যাহারের চিঠি পাওয়ার পর আবেদন করেছি। এখানে আমার কিছু করার নেই।’

রাজনীতি করলে মামলা থাকতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা–নেত্রীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।
আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ

২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী কাদেরের নাম প্রত্যাহার’ শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ, চট্টগ্রামে রেহাই পাচ্ছেন ৫০ আসামি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

আদালত সূত্র জানায়, নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ইনামুল হক দানু, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কাদেরের নাম মামলা থেকে প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করেন। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখায় আবেদন করা হয়।

এ ব্যাপারে আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতি করলে মামলা থাকতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা–নেত্রীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।’ অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুনের মামলা প্রত্যাহার করতে সুপারিশ করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এগুলো ষড়যন্ত্রমূলক। প্রত্যাহারযোগ্য হওয়ায় প্রত্যাহার হয়েছে।’ র‍্যাব-পুলিশের তালিকায় কাদেরের নাম থাকা বিষয়ে আ জ ম নাছির বলেন, ‘অনেক ভালো মানুষের নামও অনেক সময় যুক্ত করে দেয় তারা।’

পাঠানটুলীতে গুলিতে মঙ্গলবার নির্বাচনী সহিংসতায় করা খুনের মামলাটির তদন্ত করছে নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার ও বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

আজগর খুনের পর নগর আওয়ামী লীগ আবার বুধবার রাতে জরুরি সভা করে সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিদ্রোহীরা অনড় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। ৩৪ ওয়ার্ডে ৮০ জনের বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।

খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি মামলার আসামি খালাস ও দায়মুক্তি পাওয়া নাগরিক সমাজের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার হওয়ায় সমাজে অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে। সরকারি দলে যাঁরা এসব সন্ত্রাসীর পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নইলে অপরাধ বাড়তে থাকবে।