চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর আট খুন মামলা

খালাস দুজন অধ্যক্ষ মুহুরী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত

চট্টগ্রামের আলোচিত আট খুনের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি খালাস পেলেও তাঁদের মধ্যে তিনজন মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ, তাঁদের মধ্যে আলমগীর ও মোহাম্মদ আজম নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাঁরা কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন।
বাকি দুজনের মধ্যে শিবিরের ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন ভারতের কারাগারে আছেন। আর সোলায়মানের বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলা না থাকলে তিনি মুক্তি পেতে পারেন।
২০০১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জামালখান এলাকার বাসায় অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। চট্টগ্রামের আদালতে আলমগীর ও আজমের ফাঁসির আদেশ হয়।
চট্টগ্রাম কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ছগির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলমগীর ও মোহাম্মদ আজম অধ্যক্ষ মুহুরী হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাই আট খুনের মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও তাঁদের কারাগারে থাকতে হবে।’ তিনি জানান, আলমগীরের বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলার বিচার চলছে। আজমের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের পৃথক দুটি মামলা বিচারাধীন আছে।
কারাগার সূত্র জানায়, খালাস পাওয়া অন্য আসামি সাজ্জাদ হোসেন ভারতের কারাগারে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও হত্যা ও অস্ত্র আইনের কয়েকটি মামলা বিচারাধীন আছে। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
খালাস পাওয়া অন্য আসামি সোলায়মান সম্পর্কে কারাগার কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে আছেন। আর কোনো মামলা না থাকলে সোলায়মানের মুক্তি পেতে কোনো বাধা নেই বলে জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক ছগির মিয়া জানিয়েছেন।
আপিল শুনানি শেষে ১৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল হাই ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ এই চার আসামিকে খালাস দেন। হাইকোর্টের এই রায় আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি বহাল রাখেন।
২০০০ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ব্রাশফায়ারে ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মীসহ আটজনকে হত্যা করা হয়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মাইক্রোবাসে চড়ে বহদ্দারহাট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের একটি সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়ার সময় শিবিরের ক্যাডাররা এই নারকীয় হামলা চালায়। এতে আটজন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে দুজন গাড়ির চালক ছিলেন। ছাত্রলীগের নিহত ছয় নেতা-কর্মী চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরউদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ একরামুল হক চৌধুরী চারজনকে ফাঁসি ও তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
দুর্বল সাক্ষ্য: ফাঁসির চার আসামির হাইকোর্টে অব্যাহতি পাওয়া নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে। সময়মতো তাঁরা নিম্ন আদালতে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দেননি। আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করারও উদ্যোগ নেয়নি সংগঠন। কেবল সরকারি কৌঁসুলির ওপর নির্ভরতার কারণে উচ্চ আদালতে ফলাফল আসামিদের অনুকূলে গেছে বলে দলীয় নেতা-কর্মীরা মনে করছেন।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতে দুই আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে খুনিদের নামধাম প্রকাশিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে নিম্ন আদালত রায় দেন। হাইকোর্টে কী কারণে ফাঁসির আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন, তা রায়ের অনুলিপি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত বলতে পারছি না।’
মামলার বাদী মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারকাজ শুরুর আগেই বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। ওরা আমাকেসহ তিনজনকে কারাগারে পাঠায়। আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। আমরা নিম্ন আদালতে দক্ষ উকিল চেয়ে দলের কাছ থেকে পাইনি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে অনেকে আদালতে গিয়ে মুখ খুলে কথা বলতে পারেনি।’
ব্যর্থতার অভিযোগ স্বীকার করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মামলাটির শুনানির সময় সংগঠন বাদীকে আইনি সহায়তা দিতে পারেনি। সরকারি কৌঁসুলির ওপর নির্ভরতার কারণে আসামিরা ঠিকই হাইকোর্টে পার পেয়ে গেছেন।
এই মামলার চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের তৎকালীন সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আহসানুল হক হেনাও ওই সময়ে বলেছিলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চারদলীয় জোটের সমর্থক ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল, যে কারণে ঘটনার শিকার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের আত্মীয়রা আদালতে আসল বক্তব্য উপস্থাপনের সাহস পাননি। মামলার বাদীসহ একাধিক সাক্ষীকে এ কারণে বৈরী ঘোষণা করা হয়। এর পরও আসামি সোলায়মান ও আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ইমন ওরফে রিমানের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দীকে মামলার অন্যতম ভিত্তি বলে যুক্তিতর্কে উপস্থাপন করা গেছে।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, সন্ত্রাসী আবদুল কাইয়ুম ওরফে ইমন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি হত্যাকাণ্ডে আটজন সরাসরি জড়িত বলে জানান। ইমনের স্বীকারোক্তির সঙ্গে আরেক আসামি সোলায়মানের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি প্রায় মিলে গিয়েছিল। তিনিও আটজনের নাম প্রকাশ করেন, যাঁরা মাইক্রোবাসে করে এসে হত্যাকাণ্ড ঘটান।
নিম্ন আদালতে কাইয়ুমের যাবজ্জীবন এবং সোলায়মানের মৃত্যুদণ্ড দেন। হাইকোর্ট অবশ্য সোলায়মানকে খালাস দেন।