খাবারের ব্যয় কাটছাঁট ৪৩% পরিবারে

করোনাকালের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বড় অংশের মানুষ। বেশির ভাগেরই আয় আগের জায়গায় ফেরেনি।

সূত্র: সিপিজের জরিপ

করোনাকালের আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে খাবারের ব্যয় কমিয়েছে বড় অংশের মানুষ। সর্বশেষ এ হার দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। এর বাইরে কেউ কেউ সঞ্চয় ভেঙে চলছেন। আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়ে কোনো রকমের দর–কষাকষি ছাড়াই নিম্ন মজুরির কাজে যোগ দিয়েছেন।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়।

এতে দেখা যায়, মানুষের আয় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত জুনে যেখানে ৬৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন তাঁদের আয় কমেছে, সেখানে ডিসেম্বরে হারটি দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে। তারপরও দেখা যাচ্ছে, অর্ধেকের বেশি পরিবারের আয় আগের পর্যায়ে ফেরেনি। ওদিকে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।

জরিপে গত ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ পরিবার যেমন খাবার কেনাকাটায় খরচ কমানোর কথা জানিয়েছে, তেমনি ৩৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা কম মজুরির কাজে যোগ দিয়েছেন। সঞ্চয় থেকে খরচ করেছেন ২৬ শতাংশ।

সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বগতি। ক্রেতাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। এর মধ্যে টিসিবি তিন ধরনের পণ্য বিক্রি করছে। সেখানে চিনি ডাল পাওয়া গেলেও অল্প সময়ের মধ্যে ফুরিয়ে যাচ্ছে সয়াবিন তেল। তবুও চিনি ডাল কিনতে টিসিবির ট্রাকের সামনের ক্রেতাদের হুমড়ি খাওয়া অবস্থা

সিপিজে ‘করোনার অতিমারিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা প্রণয়নে প্রান্তজনের কণ্ঠস্বর’ শিরোনামের জরিপটি করেছে তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে গত বছরের জুনে, দ্বিতীয় ধাপে সেপ্টেম্বরে এবং তৃতীয় ধাপে ডিসেম্বর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে ২০টি জেলার ৪০টি উপজেলার দেড় হাজার পরিবারকে নেওয়া হয়েছিল, যা মূলত শহরের বস্তিবাসী, গ্রামের দরিদ্র, পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং নারী প্রধান ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবার।

জরিপটি করতে সহায়তা করে ব্রিটিশ সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) এবং যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের কোভিড কালেক্টিভ প্ল্যাটফর্ম।

জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক মৃন্ময় সমদ্দার, গবেষণা সহযোগী নাহিদা আক্তার এবং হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম। কোভিড-১৯ সম্পর্কে জ্ঞান, সচেতনতা ও আচরণ, টিকার বিস্তৃতি, অভিঘাত ও নাজুক পরিস্থিতি, সংকট মোকাবিলায় কৌশল, রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এবং সামাজিক সংহতি এ ছয় বিষয়ের ওপর জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।

এর আগে আরও কয়েকটি জরিপে করোনাকালে মানুষের আয় কমে যাওয়া, দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়া এবং মানুষের দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছিল। যেমন ২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানায়, করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ব্র্যাক ইনস্টিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপের তথ্যে বলা হয়েছিল, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এ জরিপের ফল প্রকাশ করা হয় গত বছরের নভেম্বরে।

এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানিয়েছিল, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ, যা করোনার আগে ২১ শতাংশের মতো ছিল। যদিও সরকার নতুন দরিদ্রের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, দ্রুত সরকারের নিজস্ব একটি জরিপ করা উচিত। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নইলে পরিস্থিতি তো বোঝা যাবে না।’ সিপিজের জরিপ নিয়ে তিনি বলেন, দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হচ্ছে না। এখন তো নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। ফলে মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

টিকে থাকতে ঋণ

জরিপে দেখা যায়, আর্থিক সংকটের মধ্যে টিকে থাকতে গত জুনে ঋণ নিয়েছে ৬৬ শতাংশ পরিবার। ডিসেম্বরে এ হার ৩৪ শতাংশে নামে। ডিসেম্বরেও যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের এক–তৃতীয়াংশ সেই টাকা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনেছেন। এক–চতুর্থাংশ আগের ঋণ পরিশোধ এবং কিছু অংশ ওষুধ কেনা ও চিকিৎসার খরচ চালানো ইত্যাদি কাজের জন্য খরচ করা হয়েছে। ঋণ নেওয়ার উৎস হচ্ছে মহাজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব।

ঋণের বিষয়ে সিপিজের গবেষণা সহযোগী নাহিদা আক্তার বলেন, ঋণ নেওয়ার হার কমেছে, তার মানে এ নয় যে ওই ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেছে। অনেকে আগের ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই নতুন করে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন।

কাজের অভিজ্ঞতার তথ্য তুলে ধরে নাহিদা বলেন, রাজধানীর এক বয়স্ক বস্তিবাসী নারী তাঁকে জানিয়েছিলেন, দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মেয়েদের মজুরি না বাড়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না তাঁরা। দুই বেলা খাবার খান। একজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ২০০ টাকা বাকি আছে। সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভোগেন তিনি।

ব্যয় কমাতে যেসব উপায়

জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর—এ তিন সময়েই সংসারের ব্যয় সামলাতে মানুষ খাদ্যের বাজেটে কাটছাঁট করেছেন। জুনে ৪২, সেপ্টেম্বরে ৫৬ ও ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ পরিবার উত্তর দিয়েছে যে তারা খাবারের ব্যয় কমিয়ে সংসারের খরচ সামলানোর চেষ্টা করেছে। এরপরে ছিল সঞ্চয় ভেঙে চলা। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে চলেছে। সেপ্টেম্বরে ২৬ শতাংশ পরিবার বলেছিল, তারা তাদের স্কুলগামী সন্তানকে কাজে পাঠিয়েছিল। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ডিসেম্বরে হারটি ১ শতাংশে নেমেছে।

কোভিড-১৯–এর প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি সহায়তা পাওয়ার হার কমেছে। গত বছরের জুনে পরিবারগুলোর ২৮ শতাংশ সরকারের অর্থ ও খাদ্যসহায়তা পেয়েছিল। জুন ও ডিসেম্বরে তা ১১ শতাংশ নেমেছে।

টিকা পরিস্থিতি

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোভিড-১৯ যে একটি ভয়াবহ সংক্রামক রোগ, সে সম্পর্কে সচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে টিকার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব। এরপরও ৩১ শতাংশ পরিবারের এমন সদস্য আছেন, যাঁরা প্রথম ডোজের টিকার জন্য ডিসেম্বরেও নিবন্ধন করেননি।

আলোচনা

রেশন ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণের পরিবর্তে প্রান্তিক মানুষকে সহায়তার জন্য নগদ অর্থ প্রদান, ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া, স্থানীয় সরকার কার্যালয়ের মাধ্যেম ত্রাণ সাহায্যের জন্য নিবন্ধন দেওয়া, নগদ অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক এবং মোবাইল ফাইন্যান্স প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করা ইত্যাদির সুপারিশ করা হয় জরিপ প্রতিবেদনে।

অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্যে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) অন্যতম উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, সরকার এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে খাবার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটা ভালো পদক্ষেপ। তবে কী প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিলে সরকারের সহায়তা যাঁদের প্রয়োজন, তাঁদের কাছেই সহায়তা পৌঁছাবে, সেটি ঠিক করা প্রয়োজন। কারণ, এর আগে সরাসরি মুঠোফোনে অর্থসহায়তা দেওয়ার উদ্যোগটি কাজ করেনি।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিপিজের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান বলেন, কোভিড প্রান্তিক মানুষের ওপর আর্থসামাজিক নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে।