খাদ্যসংকটে বানভাসি মানুষ

বন্যায় ঘর ভাসিয়ে নিয়েছে। শেষ সম্বলটুকু নিয়ে সেতুর ওপর আশ্রয় নিয়েছেন মনিরা বেগম। গতকাল দুপুরে ইসলামপুর উপজেলার আমতলী সেতুর ওপর। ছবি: প্রথম আলো
বন্যায় ঘর ভাসিয়ে নিয়েছে। শেষ সম্বলটুকু নিয়ে সেতুর ওপর আশ্রয় নিয়েছেন মনিরা বেগম। গতকাল দুপুরে ইসলামপুর উপজেলার আমতলী সেতুর ওপর।  ছবি: প্রথম আলো

‘তিন দিন হইল বানের পানির মধ্যে। দুই দিন কোনো রহম ঘরের মাচার মধ্যে শুয়ে ছিলাম। গত রাতে হোতে সবকিছু ভাসায় নিল। গরু-ছাগলও ভাসায় নিত। আগেই মাচার ওপর রাখছিলাম। সারা রাত মাচা ধরে গরু-ছাগল রক্ষা করছি। নাও দিয়ে ভোরে সেতুর ওপর গরু-ছাগল লইয়া ঠাঁই নেয়। রাত থেকে পেটে কোনো খাউন নাই।’

গতকাল সোমবার দুপুরে বন্যাদুর্গত জামালপুরের ইসলামপুরের আমতলী সেতুর ওপর আশ্রয় নেওয়া মনিরা বেগম এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। মনিরার মতো উপজেলার আমতলী সড়ক, চিনাডুলী এস এম উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র, ডেবরাইপেচ সড়ক, দেওয়ানপাড়া সড়ক, নোয়ারপাড়া সড়ক ও বাবনা রাস্তায় শত শত বানভাসি পরিবার গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে।

গতকাল সকালে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ডাংধরা ইউনিয়নের পাথরের চর গ্রামের রাকিবুল ইসলামের ছেলে সাইমুন ইসলাম (৭), একই উপজেলার পৌর শহরের চরকালিকাপুর গ্রামের মনির হোসেনের ছেলে রিয়ামুল হক (২) ও মেলান্দহ উপজেলার খাশিমারা গ্রামের শাহ আলমের ছেলে জুনাইদ ইসলাম (১৫) বন্যার পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া রোববার সন্ধ্যায় মাদারগঞ্জের চরপাকেরদহ ইউনিয়নের ঝাড়কাঁটা গ্রামের হারেজ উদ্দিনের মেয়ে সাদিয়া আক্তার (৭) বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে।

সকাল থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। উপজেলার পশ্চিম অঞ্চলের সাতটি ইউনিয়নের পুরোটাই পানিতে ভাসছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। প্রতিবছরই তাঁরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁদের সবার অবস্থা করুণ। বেশির ভাগের ঘরের ধান-চাল, মাঠের ফসলসহ আসবাব পানির স্রোতে ভেসে গেছে।

দুর্গত এলাকার বেশির ভাগ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা। এখনো দুর্গত বেশির ভাগ এলাকায় পৌঁছায়নি ত্রাণসামগ্রী। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় অনেক দুর্গত মানুষ রাস্তা, সেতু ও বাঁধের ওপর আশ্রয় নিচ্ছেন।

দুপুরে নৌকায় করে চিনাডুলী এস এম উচ্চবিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্রের চারপাশে পানির প্রচণ্ড স্রোত। ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রায় ২০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

শিংভাঙা গ্রামের কৃষক মো. নছিমন জানান, রোববার রাতে তাঁর পুরো ঘর বানের পানিতে ভেসে গেছে। তিনি গরু আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে কোনোরকমে একটা নৌকায় তুলে সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, সবশেষ রোববার দুপুরে তাঁরা ভাত খেয়েছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত আর কিছুই খাননি।

এ বিষয়ে ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সরকারি হিসাবে ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। একসঙ্গে সবাইকে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে প্রতিদিন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ চলছে। যেসব এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি, সেখানে দ্রুত ত্রাণ পাঠানো হবে।

জেলার সরিষাবাড়ীর ঝিনাই, সুবর্ণখালী ও যমুনা নদীর পানি ব্যাপক বেড়েছে। এতে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৫৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তারা সড়ক, বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। পাঠদান বন্ধ রয়েছে ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

পৌর শহরের বাউসী-কোনাবাড়ী গ্রাম প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় দুই সপ্তাহ ধরে বাঁধ দিয়ে মানুষজন ও যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বাঁধ রক্ষায় কোনাবাড়ী স্লুইসগেট এলাকায় বালু ও মাটি ফেলছেন এলাকাবাসী। তাদের সহায়তা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধটি রক্ষা করা না গেলে ৫টি গ্রাম প্লাবিত হবে। 

ঝিনাইগাতীতে পরিস্থিতির অবনতি

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন জানান, রোববার রাতের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মহারশি নদীর বাঁধের পূর্বদিঘিরপাড় এলাকায় ১৫০ মিটার অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় এটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ভাঙনরোধে স্থানীয় ব্যক্তিরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করছেন।

 ধানশাইল ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জানান, সোমেশ্বরী নদীর পানির প্রবল তোড়ে নয়াপাড়া, দাড়িয়ারপাড়, কান্দুলী, মাঝাপাড়া ও বাগেরভিটা গ্রামের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ধানশাইল-বাগেরভিটা-ভটপুর সড়কের। বাগেরভিটা এলাকায় সোমেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ সেতুটির দুই পাশের মাটি সরে গেছে। সেতুটি হুমকির মুখে পড়েছে। মালিঝি নদীর পাগলারমুখ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে হাতীবান্ধা-কামারপাড়ার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা।