কাগজে কলমে সময় আছে ৫৫ দিনের মতো। বাস্তবে আরও কম। বৃষ্টি শুরু হলেই বন্ধ হবে খননকাজ। আর যেভাবে মাটি ও বালি স্তূপ করে রাখা হয়েছে তাতে দুবারের বৃষ্টিতেই সব আগের যায়গায় চলে যাবে। কিন্তু ঠিকাদারদের কাজের গতি দেখে মনে হচ্ছে যেন তাঁরা বৃষ্টির জন্যই অপেক্ষা করছেন।
মাগুরায় নবগঙ্গা নদী পুনঃখনন নিয়ে এমনই মূল্যায়ন জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, নদীর কাজ শতভাগ শেষ না হলে এর কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। এক–দুই বছর পর যেখানকার মাটি সেখানেই চলে যাবে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, সব কিছু ঠিকঠাকভাবে হচ্ছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে নবগঙ্গায় পানি থাকে কানায় কানায়। মাগুরা অংশে তখন নদীর প্রস্থ হয় ৩০০ মিটার পর্যন্ত। তবে শুষ্ক মৌসুমে এই জলাধার এসে দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৪০ মিটারে। শুষ্ক মৌসুমে নদীকে জলাধার হিসেবে ব্যবহারের জন্য নবগঙ্গা পুনঃখনন প্রকল্প নেওয়া হয়। মাগুরা জেলায় নবগঙ্গা নদীর দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পুনঃখনন হচ্ছে শহরের পুর্বাশা ঘাট থেকে আলোকদিয়া সেতু পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার এলাকা। পাউবোর অধীনে চারটি প্যাকেজে ৪৩ কোটি ৩৯ লাখ ৮২ হাজার টাকা ব্যয়ে খননকাজ করছে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যাদের পক্ষে স্থানীয় দুই ঠিকাদার এহিজার রহমান লেমন ও সাখাওয়াত হোসেন কাজ করছেন।
পাউবো বলছে, গত বছরের ২ জুলাই থেকে কাজ শুরু হয়েছে। শেষ করার নির্ধারিত সময় আগামী ২০ জুন। পাউবোর কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চারটির মধ্যে একটি প্যাকেজে ৮৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। সবচেয়ে কম ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এক নম্বর প্যাকেজে। এর মধ্যে রয়েছে পূর্বাশা ঘাট থেকে বারাশিয়া বটতলা ঘাট পর্যন্ত মোট ২ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার এলাকা। শহরের মধ্যে পড়া তলনামুলক গুরুত্বপূর্ণ এই অংশটির কাজ দেরিতে শুরু হলেও শেষ করতে হবে ২০ জুনের মধ্যেই।
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, খননের পর নদীর তলদেশ হবে ৮০ মিটার প্রস্থ। গভীরতা হবে চার থেকে সাড়ে চার মিটার পর্যন্ত। মাটি ফেলতে হবে খনন স্থলের ৩০ থেকে ১০০ মিটার দূরে। আর খননকাজে ব্যবহার করতে হবে লং বুম্ব এক্সেভেটার।
গত কয়েকদিনে নবগঙ্গা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, অনেক জায়গাতে মাটি ফেলে রাখা হয়েছে নদীর মধ্যেই। লং বুম্ব এক্সেভেটার ব্যবহারের কথা থাকলেও বেশিরভাগ জায়গায় তা হচ্ছে না। যেসব ড্রেজার ব্যবহার করা হচ্ছে তাও কম শক্তিশালী ড্রেজার। ফলে নিয়ম অনুযায়ী গভীর হচ্ছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
এক নম্বর প্যাকেজের আওতায় পারনান্দুয়ালি নতুন ও পুরাতন ব্রিজের মাঝের কয়েকশ মিটার এলাকায় এখনো কাজই শুরু করতে পারেনি ঠিকাদার। ঢাকা রোডে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পেছনের অংশেও অল্প কয়েকটি কম শক্তিশালী ড্রেজার দিয়ে কাজ চলছে। এই অংশের কাজ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পারনান্দুয়ালি গ্রামের এক বাসিন্দা জানালেন, নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। আর কিছুদিন গেলে সব চরই ডুবে যাবে। তখন এই নামমাত্র কাজ দেখিয়েই বিল তুলে নেবে ঠিকাদার। চার ইঞ্চি পাইপের যেসব ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ চলছে তাতে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা কোন ভাবেই সম্ভব না বলেই মনে করছে স্থানীয়রা।
এই কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে একটি কমিটি করা হয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান। গত বুধবার প্রকল্প এলাকা পর্যবেক্ষণ শেষে এক নম্বর প্যাকেজের কাজের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ওই এলাকায় যেসব মেশিন (এক্সেভেটার ও ড্রেজার) ব্যবহার করা হচ্ছে তা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। কয়েকটি জায়গায় মাটি ও বালি ফেলা হয়েছে নদীর মধ্যেই।’ সব মিলিয়ে এ অংশে কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া যেসব জায়গায় ইতিমধ্যে খনন কাজ শেষ হয়েছে সেখানকার মাটি নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা না করলে কাজের কোনো সুফল পাওয়া যাবেনা বলে মনে করেন জেলা প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা।
এক নম্বর প্যাকেজে তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন, মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম। এই অংশে ১৪টা ড্রেজার ও ৮টি এক্সেভেটার দিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার বিষয়ে তারা আশাবাদী। এ জন্য ঠিকাদারকে আরও কিছু খনন যন্ত্র বাড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঠিকাদার এহিজার রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর সহকারী রিপন জানিয়েছেন, শিগগির আরও কিছু ড্রেজার যোগ করবেন তারা।
মাগুরা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এবিএম খান মোজাহেদী বলেন, নির্ধারিত সময়ে শতভাগ কাজ শেষ করার ব্যপারে তাঁরা আশাবাদী। কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদার বিল পাবেন না। যে যুটুকু কাজ করবেন শুধু সেটুকুর বিল পাবেন।