ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষার কাজে তেমন উন্নতি নেই

গত বছর (২০২১) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক পেয়েছেন মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। তিনি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার প্রসারে কাজ করেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম, ভাষার বিপন্নতা ও এসব রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা
প্রশ্ন

প্রথম আলো: পাঁচ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাক্‌–প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর হলো। আপনার প্রতিষ্ঠানও এই কাজের সঙ্গে জড়িত। কতটুকু অগ্রগতি হলো এই সময়ে?

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: মূলত ২০১২-১৩ সাল থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আমরা শিখন-শেখানোর উপকরণগুলো মাঠে পেয়েছি ২০১৭ সালে। তার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। শিখন-শেখানোর উপকরণগুলো মাঠে পাওয়ার পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এ বছর। এই পাঁচ বছরে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি তেমন দৃশ্যমান নয়। সমতলের (গারো ও সাদরি) মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক নিয়োগ বা পদায়ন কোনোটাই হয়নি, সরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখনো শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো মাঠপর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনোরূপ দিকনির্দেশনা দেয়নি এবং ক্লাস রুটিনও কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া হয়নি। এসব কারণ ও সর্বশেষ কোভিড–১৯–এর কারণে শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম আশানুরূপ অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এ ভাষায় যাঁরা শিক্ষাদান করবেন, সেই শিক্ষকদের নিজ ভাষা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কতটুকু হয়েছে? শিক্ষক সংকটও একটা সমস্যা। সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারি স্তরের চেষ্টা কতটুকু আছে বলে মনে হয়।

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: সরকার প্রথম পর্যায়ে যে পাঁচ ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে, তার মধ্যে দুটি সমতলের এবং তিনটি পার্বত্য অঞ্চলের। শিক্ষক সংকট রয়েছে দুই অঞ্চলেই। পাহাড়ে শিক্ষক সংকট মূলত পদায়নে। সংখ্যাগত দিক দিয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষার পর্যাপ্ত শিক্ষক এখানে থাকলেও যে ভাষার শিক্ষক যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সে ভাষার শিক্ষক নেই। যেমন ধরুন, চাকমা স্কুলে মারমা শিক্ষক, মারমা স্কুলে ত্রিপুরা শিক্ষক, ত্রিপুরা স্কুলে চাকমা শিক্ষক অথবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাভাষী শিশুদের স্কুলে বাঙালি শিক্ষক। সমতলের ক্ষেত্রে সংকটটি ভিন্ন মাত্রার। গারো ও সাদরি ভাষাভাষী এলাকার স্কুলগুলোতে এই দুই ভাষার শিক্ষক নেই বললেই চলে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি দৃশ্যমান নয়। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো মাঝেমধ্যে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে কিছু কিছু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, যা স্থায়ী সমাধান নয়। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ বা পরিকল্পনা এখনো দেখা যায়নি। শিক্ষক প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল প্রণয়ন করা হয়নি এখনো। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোতে। এসব কারণে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে আলোর মুখ দেখছে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যারা সংখ্যার দিক থেকে বেশি, তাদের ভাষাতেই মূলত প্রাক্‌–প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদান হচ্ছে। বাংলাদেশে একাধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে, যাদের ভাষা প্রায় বিপন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামেও এমন জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সুরক্ষায় কী করা উচিত বলে মনে হয়, এ প্রচেষ্টাই–বা আছে কতটুকু?

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে দেশে যদি একজন শিশুও স্বতন্ত্র কোনো ভাষায় কথা বলে, তবে তার মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারেই মূলত বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পর্যায়ক্রমে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। পরিকল্পনা অনুসারে প্রথমে চাকমা, মারমা, ককবরক (ত্রিপুরা), সাঁওতাল, সাদরি ও গারো—এ ছয়টি ভাষায় কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। লিপি নিয়ে সাঁওতালদের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক সমাধান না হওয়ায় প্রথম ধাপ থেকে তাদের ভাষা বাদ পড়ে যায়। দ্বিতীয় ধাপে ম্রো, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি, মৈতৈ মনিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বম এবং তৃতীয় ধাপে কোচ, কুড়ুখ, হাজং, রাখাইন, খুমি ও খিয়াং ভাষায় পর্যায়ক্রমে নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ার কথা। পরিকল্পনাগুলো যদি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে দেশের সব ভাষাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় চলে আসত। কিন্তু কার্যক্রমটি অতি ধীরগতিতে অগ্রসর হওয়ায় এখনো প্রথম পাঁচ ভাষাতেই আটকে রয়েছি আমরা।
বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক মানুষের ব্যবহৃত ভাষা অনেক রয়েছে। লাড়া, কডা, চাক, খুমি, রেংমিটচার মতো অনেক ভাষা রয়েছে, যেগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে অচিরেই হারিয়ে যাবে। এসব বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য, উন্নয়নের জন্য ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্যবহারে উপযোগী করে তোলার জন্য সরকারের বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। রেংমিটচা ভাষায় বর্তমানে মাত্র ছয়জন মানুষ কথা বলেন, যাঁদের সবাই ষাটোর্ধ্ব। তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষাটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। এরূপ বিপন্ন ভাষাগুলো সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটসমূহ গবেষণা, ডকুমেন্টেশন, প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ, আলোচনা-সংলাপ-সেমিনার ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাবিষয়ক বিশেষ সেল বা ইউনিট স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে সংশ্লিষ্ট ভাষার বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতেরা প্রতিনিয়ত গবেষণা পরিচালনা করতে পারবেন।

মূলত ২০১২-১৩ সাল থেকেই মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আমরা শিখন-শেখানোর উপকরণগুলো মাঠে পেয়েছি ২০১৭ সালে। তার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কিন্তু সমতলের (গারো ও সাদরি) মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক নিয়োগ বা পদায়ন কোনোটাই হয়নি, সরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখনো শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো মাঠপর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনোরূপ দিকনির্দেশনা দেয়নি এবং ক্লাস রুটিনও কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া হয়নি।
প্রশ্ন

প্রথম আলো: ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার সুরক্ষায় সরকারি স্তরে কিছু তৎপরতা আছে। দেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো সে ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে?

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: বেসরকারি সংগঠনগুলো প্রকল্পভিত্তিক কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে পথ দেখিয়েছে। বর্তমানে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনই বাস্তবায়ন করছে। ভাষা ডকুমেন্টেশন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহারোপযোগী করে তোলাসহ গবেষণামূলক কার্যক্রম তারা বাস্তবায়ন করেছে। সরকারের কর্মসূচির সঙ্গেও একাত্ম হয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংগঠনগুলো। স্থানীয় থেকে জাতীয় স্তরের পলিসি অ্যাডভোকেসি থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মাতৃভাষাভিত্তিক অনলাইন ক্লাস ইত্যাদিও পরিচালনা করছে বেসরকারি সংগঠনগুলো।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ভাষার সুরক্ষায় শুধু মাতৃভাষায় শিক্ষাদান নয়, এ ভাষায় সাহিত্য চর্চা ও তার প্রকাশ জরুরি। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রতিবন্ধকতা কী?

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কোনো ভাষা যদি চর্চা না হয়, তাহলে সে ভাষা বিলুপ্ত হতে বাধ্য। তাই কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ভাষা সুরক্ষা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির ভাষায় সাহিত্য চর্চায় রয়েছে নানা সংকট। প্রথমত, মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চার জন্য সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। দ্বিতীয়ত, মাতৃভাষায় প্রকাশিত সাহিত্যগুলোর বাজার–সংকট আছে। মাতৃভাষায় সাহিত্য প্রকাশ কোনো প্রকাশক-লেখকই মুনাফা অর্জনের আশা করতে পারেন না। তৃতীয়ত, মাতৃভাষার প্রমিত রূপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কোনো ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা টিকে থাকার মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী? সেগুলো মোকাবিলার উপায়ই–বা কী মনে হয় আপনার কাছে।

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: মূল চ্যালেঞ্জসমূহ হলো চর্চার ক্ষেত্র সীমিত, প্রভাবশালী ভাষাগুলোর প্রভাব, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব, নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি দরদ না থাকা, একাডেমিক চর্চার ক্ষেত্র না থাকা, স্বল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহ ডকুমেন্টেশন, লিখিতরূপ দেওয়ার জন্য (অর্থগ্রাফিসহ) পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং পর্যাপ্ত প্রকাশনার অভাব।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায় হলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চর্চার প্রবণতা বৃদ্ধি করা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাবিষয়ক সেল বা ইউনিট স্থাপন করা দরকার। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী স্টাডিজ বা ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন করে একাডেমিক গবেষণা চালু প্রয়োজন। এ ছাড়া ডকুমেন্টেশন ও আলোচনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা, প্রকাশনার জন্য অনুদান বা প্রণোদনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করতে হবে। আর বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলো ডকুমেন্টেশন ও লিখিতরূপ তৈরি (অর্থগ্রাফিসহ) করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে।