ফরিদপুরের গোহাট

ক্ষমতার দাপট কমতেই হাটের ইজারামূল্য বাড়ল ১৭৪ গুণ

খন্দকার মোশাররফের অনুগতরা বিতাড়িত হওয়ায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা ইজারায় অংশ নিতে পারছেন।

ফরিদপুর জেলার মানচিত্র
ফরিদপুর জেলার মানচিত্র

ফরিদপুর সদর উপজেলার চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের আফজাল মণ্ডলের গরু হাটটি গত বছর ৫৫ হাজার ১০০ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। এ বছর ওই হাটের ইজারামূল্য উঠেছে ৯৬ লাখ ১ হাজার ১০০ টাকা। যে কারোরই প্রথমে মনে হতে পারে, গুনতিতে ভুল হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে একটা গোহাটের ইজারামূল্য ১৭৪ গুণ বেড়ে যায় কী করে?

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ফরিদপুরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণেই এমনটা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এখানকার টেন্ডার, ইজারা, চাঁদাবাজি—সবকিছু কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন ফরিদপুর সদরের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেনের লোকজন। গত বছর ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়িতে হামলাকে কেন্দ্র করে মামলায় একে একে গ্রেপ্তার হন খন্দকার মোশাররফের অনুগত অনেকে। গ্রেপ্তার হওয়া দুই ভাই রুবেল ও বরকতের আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। এরপরই ফরিদপুর থেকে বিদায় হন মোশাররফের অনুগতরা। কেউ জেলে, অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

২০১৬ সালের ৩ আগস্ট আফজাল মণ্ডলের হাটের যাত্রা শুরু হয়। চর মাধবদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তুহিনুর রহমান মণ্ডলের প্রয়াত বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন মণ্ডলের নামে এ হাটের সূচনা হয়। হাটটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ফরিদপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী টেপাখোলা গরু হাটের ইজারাদার ও ব্যবসায়ীদের প্রবল আপত্তির মুখে ২০১৮ সালে ওই হাটে গরু ওঠানো হয়। গত বছর পর্যন্ত তিনবার হাটটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাংলা ১৪২৫ সালে একক দরপত্রদাতা হিসেবে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শওকত আলী জাহিদ ৫০ হাজার টাকায় হাটটির ইজারা পান। ১৪২৬ ও ১৪২৭ সালে একক দরপত্রদাতা হিসেবে হাটটির ইজারা পান ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনুর মণ্ডল। ইজারামূল্য যথাক্রমে ৫৩ হাজার ও ৫৫ হাজার টাকা।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, খন্দকার মোশাররফের সাবেক এপিএস এ এইচ এম ফোয়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা মিলে হাটটির পত্তন করেন। এই হাটের ইজারার সময় দ্বিতীয় কাউকে হাটের ইজারার জন্য দরপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। ফোয়াদ এখন পলাতক।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ফরিদপুরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চলতি ১৪২৮ সনের ইজারার জন্য দরপত্র পড়েছিল ১৬টি। ৯৬ লাখ ১ হাজার ১০০ টাকা দর দিয়ে হাটটির ইজারা পায় মেসার্স মণ্ডল অ্যান্ড সন্স, যার মালিক শহরের ভাটিলক্ষ্মীপুর মহল্লার বাসিন্দা আরশাদ মণ্ডল।

ফরিদপুর সদরের ইউএনও মাসুম রেজা বলেন, এক বছরের ব্যবধানে সরকারের শুধু এই একটি গরুর হাট থেকে ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বেশি রাজস্ব আয় হয়েছে।

এ বিষয়কে আমি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখি। এতে সরকারের রাজস্ব বহুগুণ বেড়েছে। আগে হয়তো কোনো কারণে টেন্ডার জমা পড়েনি।
দীপক রায়, ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা বিপুল ঘোষ বলেন, ‘খন্দকার মোশাররফ যত দিন ফরিদপুরে ক্ষমতাবান ছিলেন, তত দিন তুহিন মণ্ডল তাঁর (মোশাররফ) সুনজরে ছিল। হাটবাজারের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁর এপিএস ফোয়াদ। তবে ফোয়াদের পক্ষে মন্ত্রীর ছায়া ছাড়া এত অল্প টাকায় বিনা বাধায় হাটের ইজারা দেওয়া সম্ভব হতো না। তবে বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাটবাজারের ইজারা শতভাগ ওপেন হয়ে গেছে। ফলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারছে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়ছে।’

প্রতি সোমবার এ গরুর হাট বসে। গরুর এ হাটের আনুমানিক ১ একর ৮২ শতাংশ জায়গার মধ্যে আনুমানিক ৭৮ শতাংশ জায়গার ওপর রয়েছে। সরকারি খাসজমির পাশাপাশি এ জায়গার কিছু অংশের মালিক তুহিনুর রহমান মণ্ডল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

সাবেক ইজারাদার তুহিনুর রহমান মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নতুন হাট মেলানোর স্বার্থে এবং জনপ্রিয় করার স্বার্থে সকলের কাছ থেকে খাজনা নিইনি। আমি এলাকার চেয়ারম্যান ছিলাম বলে অনেককে বিনা খরচে বেচাকেনার সুযোগ দিতে হয়েছে। নতুন ইজারাদার যদি লাভ করতে চান, তাহলে তাঁকে খাজনা বাড়াতে হবে। এতে জনগণের ওপর জুলুম হবে।’ বিগত বছরগুলোতে আর কেউ টেন্ডার জমা না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তুহিনুর বলেন, ‘নতুন হাট, তাই আমাকে ভালোবেসে অন্য কেউ হয়তো টেন্ডার জমা দেয়নি।’

১৭৪ গুণ বেশি দরে হাট ইজারা নিয়ে ইজারাদার চালাতে পারবেন কি না, এ প্রশ্নও উঠেছে। তবে হাটের নতুন ইজারাদার আরশাদ মণ্ডল বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। হিসাব করে চলি। লাভ করতে পারব হিসাব করেই এ মূল্যে হাটের ইজারা নিয়েছি। এ ব্যাপারে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না। আশা করি সমস্যা হবে না।’

তবে হাটটি যাতে নতুন ইজারাদার বুঝে নিতে না পারেন, এ জন্য সাবেক ইজারাদার বাধা সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ১৩ এপ্রিল হাটের জায়গায় অন্তত পাঁচ শ কলাগাছ পুঁতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কয়েকটি সিমেন্টের খুঁটি এবং ওপরে টিনের চাল দিয়ে ‘আফজাল মণ্ডল জামে মসজিদ’ নামে সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি ইট গেঁথে কয়েকটি সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুম রেজা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ আল-আমিন আফজাল মণ্ডলের হাটে গিয়ে নতুন ইজারাদারকে গরু হাটের জমি বুঝিয়ে দেন। পাশাপাশি বাজারের জায়গায় কথিত মসজিদের সাইনবোর্ডটিও অপসারণ করা হয়।

ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপক রায় বলেন, ‘এ বিষয়কে আমি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখি। এতে সরকারের রাজস্ব বহুগুণ বেড়েছে। আগে হয়তো কোনো কারণে টেন্ডার জমা পড়েনি। এখন পরিবেশ ভালো। তাই সবাই টেন্ডার ড্রপ করতে পারছেন। ফলে সরকারের রাজস্ব বেড়ে গেছে। হাটের ইজারার এ মূল্য একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে আর হয়তো নিচে আসবে না। এতে প্রকারান্তরে সরকারই লাভবান হলো।’