ক্যানসার জটিল রোগ। চিকিৎসায় সময় লাগে বেশি, ব্যয়ও বেশি। চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হচ্ছেন।
রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনে ঢুকতে ডানে রাস্তার পাশে যেখানে দু-চারটি গাড়ি থাকত, সেখানে এখন রোগী। তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। ঢাকা শহরে তাঁদের স্বজন নেই, হোটেলে থাকার আর্থিক সামর্থ্য নেই। হাসপাতালের পাশে ছোট এক কক্ষের বাসা ভাড়া নেওয়াও তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। ক্যানসার চিকিৎসার জন্য তাঁরা এসেছেন বিভিন্ন জেলা থেকে। বিছানা-কাঁথা-কম্বল-থালা-বালতি নিয়ে তাঁরা গাড়ি রাখার জায়গায় থাকছেন।
ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের রাজমিস্ত্রি সিরাজ মিয়া স্ত্রীকে নিয়ে তিন দিন ধরে শীতের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় আছেন। তাঁর স্ত্রীর ক্যানসার ধরা পড়েছে। ব্যথায় কাতর। ভর্তি করাতে পারছেন না। পাশের বিছানার এক যুবক জানালেন, তাঁরা এসেছেন বরিশাল থেকে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে লঞ্চ থেকে সদরঘাট নেমেছেন। সেখান থেকে এখানে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র। এখানে রোগনির্ণয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা খরচ বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালের চেয়ে কম। সে কারণে সারা দেশের রোগীর চাপ এই হাসপাতালে। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর অনেকেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসতে পারেননি। এখন আসছেন। তাই চাপও বেশি। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ সব সময় বেশি দেখা যায়। ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায় রোগীরা বারান্দায় থাকেন। কিন্তু এমন ফাঁকা জায়গায় রোগীর ভিড় সাধারণত চোখে পড়ে না।
গতকাল হাসপাতালের বিভিন্ন তলায় গিয়ে ওয়ার্ডের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বিছানাপাতি নিয়ে রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের দেখা গেছে। তবে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালের নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডগুলোয় ফাঁকা শয্যা চোখে পড়েনি। যাঁরা ফাঁকা জায়গায় তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য মরিয়া। যাঁরা ভর্তি আছেন, তাঁদের অন্তত তিনজন বলেছেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েই তাঁরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
একদিকে ক্যানসার রোগীর চাপ, অন্যদিকে দেশে অপর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা—এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ শুক্রবার বিশ্ব ক্যানসার দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য: ক্যানসার সেবায় পার্থক্য কমান। বেশি মানুষকে সেবা দিতে হবে, সেবার ক্ষেত্রে যেন বৈষম্য না হয়। এ উপলক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাতিরঝিলে একটি নৌ শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে।
যন্ত্র নষ্ট, পদ শূন্য
গতকাল জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে রেডিওথেরাপি প্লানিং কক্ষের সামনে ভিড় চোখে পড়ে। কক্ষের সামনে অনেকে সারি ধরে মেঝেতে বসে আছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। জানা গেল, বিকিরণ চিকিৎসার যন্ত্রগুলোর অধিকাংশই নষ্ট। ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি, বিকিরণ থেরাপি ও অস্ত্রোপচার প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অল্প দিন দায়িত্ব নিয়েছেন। কয়টা যন্ত্র আছে, কয়টা নষ্ট, তা তিনি জানেন না। তবে রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম এন হক জানান, বিকিরণ দেওয়ার জন্য লিনিয়ার এক্সেলারেটর যন্ত্র আছে চারটি। এর মধ্যে তিনটিতে কাজ হয় না। দুটি কোবাল্ট যন্ত্রের একটি নষ্ট। ব্র্যাকিথেরাপি যন্ত্র আছে দুটি, এর মধ্যে একটি নষ্ট। অর্থাৎ হাসপাতালের বিকিরণ দেওয়ার আটটি যন্ত্রের পাঁচটি নষ্ট।
লিনিয়ার এক্সেলারেটর যন্ত্র চালান মেডিকেল পদার্থবিদেরা। হাসপাতালে এদের পদ আছে পাঁচটি। এসব পদে কোনো লোক নেই। যন্ত্র চালান যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লোক। দুটি বেসরকারি হাসপাতাল জানিয়েছে, একটি লিনিয়ার এক্সেলারেটর যন্ত্র দিয়ে তারা দিনে ৭০ থেকে ৯০ জনকে বিকিরণ থেরাপি দেয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এসব যন্ত্রের সেবা মানুষ পাচ্ছে না। অন্যদিকে দুর্নীতিও আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে ২০ কোটি টাকা দিয়ে একটি আধুনিক লিনিয়ার এক্সেলারেটর যন্ত্র কিনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। যন্ত্রটি এক দিনের জন্য কেউ ব্যবহার করেনি।
রোগী ও সেবায় পার্থক্য অনেক
দেশে ক্যানসারের রোগীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে দ্য গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি ২০২০ সালে ক্যানসার বিষয়ে অনুমিত তথ্য প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, দেশে প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আর ক্যানসারে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ। নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় জনস্বাস্থ্যবিদেরা এই তথ্যই ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে গত সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম অসংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, দেশে ক্যানসারে ভুগছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ।
দেশের ক্যানসার রোগীর তুলনায় চিকিৎসার আয়োজন অনেক সীমিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার কেন্দ্র বা হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন। এসব কেন্দ্রে ক্যানসার শনাক্তসহ ক্যানসার চিকিৎসার তিন ধরনের (কেমোথেরাপি, সার্জারি ও বিকিরণ চিকিৎসা) পদ্ধতি থাকতে হবে।
দেশে মানুষ ১৭ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, দেশে ক্যানসার কেন্দ্র আছে ৩৩টি। এর মধ্যে বিকিরণ যন্ত্র আছে ১৯টিতে।
ক্যানসার চিকিৎসকদের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ক্যানসারের চিকিৎসায় দেশে কমপক্ষে ২২০টি বিকিরণ যন্ত্র দরকার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে আছে ৫৭টি যন্ত্র। এর মধ্যে চালু আছে ৪৩টি। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন বেশি মানুষকে বিকিরণ চিকিৎসা দিচ্ছে।
তবে বেসরকারি হাসপাতালে খরচ বেশি। জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম এন হক বলেন, ‘আমরা যে চিকিৎসা ১০ হাজার টাকায় দিই, বেসরকারি হাসপাতালে তার জন্য কমপক্ষে ১ লাখ টাকা নেওয়া হয়, কোনো হাসপাতালে আড়াই লাখ টাকা।’
ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয়বহুল
ক্যানসার জটিল রোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসায় দীর্ঘ সময় দরকার হয়। তবে ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়। প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্ত হলে এবং যথাযথ চিকিৎসা হলে মানুষ আরোগ্য লাভ করতে পারে।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ও মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক পারভীন সাহিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সচেতনতার ঘাটতি আছে। মানুষ ঠিক সময়ে হাসপাতালে আসে না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ হওয়ার পর মানুষ চিকিৎসার জন্য আসে।
পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা সুমন হোসেন যকৃতের ক্যানসারে আক্রান্ত। কেমোথেরাপি (ওষুধের মাধ্যমে ক্যানসার চিকিৎসা) নেওয়ার জন্য সুমন ৩১ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি আছেন। কেমোথেরাপির দিন ঠিক হয়নি। এবার নিয়ে তিনটি কেমোথেরাপি শেষ হবে সুমনের। নিতে হবে আরও তিনটি। ছয়টি কেমোথেরাপি শেষ মানেই চিকিৎসার শেষ নয়।
গতকাল সকালে হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে সুমনের বাবা হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা হেলাল উদ্দিন পেশায় কৃষক। সুমন সন্তানদের মধ্যে বড়, বয়স ২০ বছর। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সুমন মানিকগঞ্জে আকিজ টেক্সটাইলে চাকরি নেন। গত বছরের মে মাসে সুমন অসুস্থ হন।
হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ছেলেরে নিয়ে একটার পর এক হাসপাতাল পাল্টাইছি, ডাক্তার পাল্টাইছি। ছেলে ভালো হয় না। শুধু টেস্টই করাইছি ২ লাখ ১৬ হাজার টাকার। শেষে জানলাম ছেলের লিভারের ক্যানসার। চিকিৎসা কবে শেষ হবে, বুঝতেছি না।’
হেলাল উদ্দিন জানান, দুই মাস আগে কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে। একবার কেমোথেরাপি শেষ হলে বাড়ি চলে যান। ২০ দিন পর নির্ধারিত তারিখে আবার আসতে হয়। তবে হাসপাতালে অনেক রোগীর চাপ, নির্ধারিত তারিখে চিকিৎসা পাওয়া যায় না, ভর্তিও হওয়া যায় না। তখন স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের পাশে একটি কক্ষ ভাড়া নেন। ভাড়া দিনে ৩০০ টাকা।
এরই মধ্যে ছেলের চিকিৎসার জন্য সামান্য সঞ্চয় যা ছিল ভেঙেছেন, আধা বিঘা জমি বিক্রি করেছেন, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করেছেন। হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘হাসপাতাল জানাইছে ছয়টা কেমোথেরাপি শেষে ছেলের লিভারের অপারেশন হবে। অপারেশনের পর রেডিও থারাপি দেবে। হের পর যদি ছেলে ভালো হয়।’
সুমনের চিকিৎসা চলবে আরও দীর্ঘদিন। পাবনা থেকে ছেলেকে নিয়ে হেলাল উদ্দিনকে বারবার ঢাকায় আসতে হবে। আসার আগে খরচের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হবে। পাবনার এই কৃষক বলেন, ‘অন্ধকার দেখতেছি।’
হাসপাতালে এক মাস সাত দিন ধরে ভর্তি আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের ভুট্টু মিয়া। তাঁর ২৪টি বিকিরণ থেরাপি নেওয়ার কথা। গতকাল পর্যন্ত ৩টি নিয়েছেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ভালো হলেও তিনি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন। তাঁর স্ত্রী বলেন, দুই লাখ টাকা নিয়ে বাড়ি বন্ধক রেখেছেন, ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন একটি এনজিও থেকে। আছে আরও অনেক দেনা।
ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত ক্যানসার শনাক্ত করতেই অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়। শনাক্ত হওয়ার আগেই অনেক খরচ হয়ে যায়। সারা দেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বলে ঢাকায় আসতে হয়। দু-তিনজন মানুষের বারবার ঢাকায় আসা-যাওয়ার খরচ, ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ অনেক। সরকারি হাসপাতালেও কিছু খরচ করতে হয়। অন্যদিকে রোগীর যাওয়া-আসা-থাকার কাজটি করতে গিয়ে অনেকের উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। তাই ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা করাতে প্রতিটি পরিবারকে অনেক মূল্য দিতে হয়।