নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর মাহমুদনগর কলাবাগান এলাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এম এল আফসার উদ্দিনকে ধাক্কা দেওয়া কার্গোটি চালাচ্ছিলেন অভ্যন্তরীণ নৌপথের চালকেরা। নিয়ম অনুসারে উপকূলীয় নৌযানটি পরিচালনার কথা উপকূলীয় (কোস্টাল) কর্মকর্তাদের।
গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজ রূপসী–৯–এর ধাক্কায় যাত্রীবাহী এম এল আফসার উদ্দিন লঞ্চটি ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুই শিশুসহ আটজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
সর্বনিম্ন নিরাপদ নাবিক সনদ অনুযায়ী, উপকূলীয় নৌযান হিসেবে কার্গো জাহাজ রূপসী-৯ পরিচালনায় কোস্টাল চতুর্থ শ্রেণির মাস্টার, কোস্টাল পঞ্চম শ্রেণির চিফ অফিসার, কোস্টাল চতুর্থ শ্রেণির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও কোস্টাল পঞ্চম শ্রেণির সেকেন্ড অফিসার থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। তবে কার্গোটির অনুকূলে দেওয়া ফিটনেস সনদে দেখা যাচ্ছে, এটি চালাচ্ছিলেন প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. রমজান আলী শেখ, দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার মো. নুরুল আলম, অভ্যন্তরীণ নৌপ্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ড্রাইভার মো. নাদিম।
নৌপরিবহন অধিদপ্তর বলছে, এমভি রূপসী-৯ নামের কার্গোটি সিটি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিটি নেভিগেশনের মালিকানাধীন। নৌযানটি সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে চট্টগ্রামের বাণিজ্য দপ্তর থেকে নিবন্ধিত (নিবন্ধন নম্বর এইচটি-১১৭)।
সর্বনিম্ন নিরাপদ নাবিক সনদ অনুযায়ী, নৌযানের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল না পাওয়া গেলে দৈনিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাপাতে হবে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কেউ সাড়া না দিলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এক ধাপ কম যোগ্যতার নাবিক দিয়ে নৌযান চালানো যাবে। বিশেষ এ অনুমতিকে ডিসপেনসেশন বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোস্টাল পঞ্চম শ্রেণির সেকেন্ড অফিসার পাওয়া না গেলে ডিসপেনসেশন সনদ নিয়ে প্রথম শ্রেণির ড্রাইভার দিয়ে নৌযান চালানো যাবে। তবে এই বিশেষ অনুমতি কতবার নেওয়া যাবে, তা সর্বনিম্ন নিরাপদ নাবিক সনদে বলা নেই।
রূপসী–৯ কার্গো জাহাজের মালিকের দাবি, চট্টগ্রামের নৌবাণিজ্য দপ্তরের বিশেষ অনুমতি নিয়ে জাহাজটি চলছিল। ১৯ মার্চ শেষ হয় প্রথম দফায় বিশেষ অনুমতি নিয়ে চালানোর তিন মাস। পরে এ সময় দ্বিতীয় দফায় আবার ৮ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
উপকূলীয় নৌযান হলেও এমভি রূপসী-৯ কেন অভ্যন্তরীণ নৌপথের জনবল দিয়ে চালানো হচ্ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে কার্গোটির স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান সিটি নেভিগেশনের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) এস এম কামাল হোসেনের মুঠোফোনে গতকাল রাতে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, তাঁরা বিশেষ অনুমতি (ডিসপেনসেশন) নিয়েছেন। তবে আজ সোমবার বেলা একটা পর্যন্ত তিনি সেই সনদ দেখাতে পারেননি।
মুঠোফোনে আবার যোগাযোগ করা হলে এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘এমভি রূপসী-৯ তিন দিন আগে একজন অভ্যন্তরীণ নৌপ্রকৌশলী (ইনল্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ার) নিয়োগ দিয়েছেন। দুর্ঘটনার সময় তিনিও ওই কার্গোতে ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ফি জমা দিয়ে অনুমতির জন্য আবেদন করেছি। তবে এখনো নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি পাইনি।’
এস এম কামাল হোসেন আরও বলেন, কার্গোতে কর্মরত প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. রমজান আলী শেখের ডিসপেনসেশন থাকলেও তা এই জাহাজের অনুকূলে ছিল না।
সর্বনিম্ন নিরাপদ নাবিক সনদ অনুযায়ী, জাহাজে নতুন চালক নিয়োগ দিলে নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমতি (এনডোর্সমেন্ট) নিতে হয়। তবে সেই অনুমতি না নিয়েই অভ্যন্তরীণ নৌপ্রকৌশলীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নৌযানটির ফিটনেস সনদে দেখা যায়, গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর নৌযানটির জরিপ করেছিলেন বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার গিয়াসউদ্দিন আহমদ। তখন নৌযানটিকে নয়টি শর্তে ফিটনেস দিয়েছে নৌবাণিজ্য দপ্তর। এতে ‘সর্বনিম্ন নিরাপদ নাবিক সনদ অনুযায়ী নাবিক নিয়োগ দিতে হবে’ বলা হয়েছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বার্ষিক জরিপের সময় ডিসপেনসেশন সনদ থাকলে এ শর্ত দেওয়ার কথা নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গিয়াসউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে এসব জাহাজে চাকরি করার মতো কোনো লোক নেই। ওরা প্রতিবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়, কিন্তু লোক পায় না। জাহাজটিতে কর্মরত নাবিকদের ডিসপেনসেশন আছে বলে দাবি করেন গিয়াসউদ্দিন আহমদ।
অভ্যন্তরীণ নৌপথ বিষয়ে দায়িত্ব পালনকারী নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, শীতলক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জের যে জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা অভ্যন্তরীণ নৌপথ। যেসব মাস্টার-ড্রাইভার কর্মরত ছিলেন তাঁরা এ নৌপথে নৌযান চালাতে পারদর্শী হওয়ার কথা। দুর্ঘটনার সময় কর্মরত মাস্টার-ড্রাইভাররা দায়িত্ব পালন করছিলেন কি না, বা আদৌ তাঁরা জাহাজেই ছিলেন কি না, তা তদন্ত করে দেখা দরকার।