আমরা বর্তমানে ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একদিকে মহামারি করোনা-১৯ যেমন সারা বিশ্বসহ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আমফান এবং বন্যা, যেখানে প্রায় ২১ জেলার মানুষ বন্যাকবলিত। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের অবস্থা আমাদের দেশে থেকে কবে পরিসমাপ্তি ঘটবে, তারও কোনো সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দশম এবং আক্রান্তের দিক থেকে বিশ্বের ১৭তম। আপাতদৃষ্টে কোনো কোনো জেলায় সংক্রমণের হার কম হলেও সঠিক চিত্র এখনো ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আজকের লেখার বিষয়বস্তু সামনে ঈদুল আজহা নিয়ে। আমাদের সামনে পবিত্র কোরবানির ঈদ ধর্মীয় বিধান অনুসারে সবাই সাধ্যমতো গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা প্রভৃতি পশু এ ঈদে কোরবানি দিয়ে থাকেন। অনেকেই ধারণা করছেন কোরবানির ঈদের মধ্যে পশু বেচাকেনা, পরিবহন, বাজার ব্যবস্থাপনা ও ক্রেতার ভিড়, পশুর অবস্থান ইত্যাদির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে দেশে করোনা-১৯ ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়তে পারে। দেশে এখনো অনলাইনে পশু কেনাবেচা জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। তথাপি এ বছর ছোট–বড় অনেক সংস্থা বা ব্যক্তি উদ্যোগে অনলাইনে পশু বেচাকেনার ব্যবস্থা করেছেন, যা সূচনাপর্ব বলা যায়। ভোক্তার আস্থা অর্জন করতে পারলে অনলাইন ব্যবসা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে মনে করি। তবে কোরবানির হাট থেকে সিংহভাগ গবাদি প্রাণী কেনাবেচা হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই কোরবানির হাটে সংক্রমণ রোধ করার জন্য যেসব কার্যক্রম বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা আলোচনা করা হলো—
কোরবানির হাটকে অধিকতর নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনা করার জন্য তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অংশীদারত্ব রয়েছে। ১. স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি বা ইজারাদার; ২. ব্যবসায়ী/বিক্রেতা; ৩. ক্রেতা, যারা হাটের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে।
উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই কোরবানির হাট স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনা করার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী স্থানীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় প্রশাসনের সঙ্গে দুটি সভা করেছেন এবং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করোনাকালীন মানুষ যাতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে কোরবানির পশু কিনতে পারে, সে জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। প্রতিটি উপজেলায়, জেলায় ও বিভাগীয় পর্যায়ে যাতে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচা করা যায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছেন। অনেকেই ধারণা করছে, এ বছর প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ গবাদি প্রাণী অনলাইনের মাধ্যমে বেচাকেনা হতে পারে। বাকি পশু বেচাকেনা হাটের মাধ্যমেই হবে ধরে নেওয়া যায়।
স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পশু বেচাকেনা করার জন্য স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি/ইজারাদারদের নিম্নলিখিত কাজগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার।
স্থানীয় প্রশাসন বা ইজারাদার
১. স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বা স্থানীয় প্রশাসন অথবা ইজারাদারেরা যতটা সম্ভব খামারিরা যাতে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচা করতে পারেন, তার সংযুক্ত করে দেওয়াসহ বড় বড় শহর ও টাউনে সম্পূর্ণ আলাদা জায়গায় পশু কোরবানির ব্যবস্থা করা।
২. এমন খোলা জায়গায় হাটের অবস্থান করা, যাতে আবাসিক বা জনবহুল এলাকা থেকে অনেক দূরে থাকে।
৩. স্থানীয় প্রশাসন বা হাট ইজারাদারেরা, প্রাণী বিক্রেতা যাতে সামাজিক দূরত্ব মেনে পশু বিক্রি করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা।
৪. সরকারের নির্দেশনা অনুসারে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে বাধ্যতামূলক মাক্স ব্যবহার করা এবং হাটে যাতে কেহ মাক্স ছাড়া প্রবেশ করতে না, পারে তা নজরদারিতে রাখা।
৫. স্থানীয় প্রশাসন বা ইজারাদারেরা হাটের প্রবেশদ্বারে এবং বাইরে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা।
৬. প্রবেশপথে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে তাপমাত্রা নির্ণয়নের ব্যবস্থা রাখা, যাতে অসুস্থ ব্যক্তি হাটে প্রবেশ করতে না পারে।
৭. হাটের সময় নির্ধারণ করা, যাতে ক্রেতা সময় বুঝে হাটে প্রবেশ করতে পারেন।
৮. হাটের প্রবেশদ্বারে ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ রাখা, যাতে একসঙ্গে দল বেঁধে প্রবেশ করতে না পারে।
৯. হাটের প্রবেশপথে হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে গবাদি প্রাণীর কেনাবেচার প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা।
১০. হাটের নির্দিষ্ট স্থানে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে।
১১. হাটে ক্রেতাদের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা।
বিক্রেতার করণীয়
১. সব বিক্রেতাকে বাধ্যতামূলক মাক্স পরিধান করার ব্যবস্থা করা।
২. হাটে বিক্রেতাদের হাত ধোয়া বা জীবাণুনাশক দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা।
৩. বিক্রেতা যাতে দুই মিটার দূরত্বে কোরবানির পশু বাঁধতে পারেন, ইজারাদারদের তা ব্যবস্থা করা।
৪. ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে দুই মিটার দূরে সামাজিক দূরত্বে কেনাবেচা করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা।
৫. পশুর গায়ে গ্লাভস ছাড়া হাত না দেওয়া।
৬. জ্বর, কাশি উপসর্গ নিয়ে কোনো বিক্রেতা যাতে হাটে প্রবেশ করতে না পারে, তার নজরদারি করা।
৭. হাটে প্রবেশের ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করা।
৮. ক্রেতা ও বিক্রেতা সরকারের সময় সময়ে জারি করা পালনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে স্থানীয় ইজারাদারদের সচেতনতার ব্যবস্থা করা।
ক্রেতার করণীয়
১. ক্রেতাকে অবশ্যই সরকারি নিয়ম অনুসারে মাক্স ব্যবহার করা।
২. জ্বর, কাশি ও ঠান্ডা নিয়ে বাজারে প্রবেশ না করা।
৩. গবাদি প্রাণীকে গ্লাভস ছাড়া গায়ে হাত না দেওয়া।
৪. হাটের কোনো স্থাপনা বা অন্য কোনো সরঞ্জামে অযথা হাত না দেওয়া।
৫. নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রাণী কেনা।
৬. সরকার কর্তৃক প্রদত্ত স্বাস্থ্যবিধি মানা বা অনুসরণ করা।
সবার অংশগ্রহণ ও নিজ নিজ অবস্থান থেকে করণীয় বিষয়গুলো যথাবিধি প্রতিপালনের মাধ্যমে নিরাপদ পশুর হাট বিষয়টি নিশ্চিত করি। আসন্ন ঈদ উৎসব সবার জন্য নিরাপদ ও আনন্দঘন হয়ে উঠুক।
*লেখক: মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), সাভার, ঢাকা