‘এই ঘর বানায়া আর কী হইব, আমার ভাই তো আর আইব না’, বলে অঝোরে কাঁদছিলেন সুমি আক্তার। বড় ভাইকে বিয়ে করানোর জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, তারই অংশ হিসেবে নতুন করে একটি টিনের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঈদের আগে পাত্রীও দেখা হয়েছে। কিন্তু দিন–তারিখ ঠিক করার আগেই সুমির ভাই রাকিবুল ইসলাম (২৫) নেত্রকোনার উচিতপুরে নৌকাডুবির ঘটনায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
গতকাল বুধবার ঘটনার পর থেকেই রাকিবুল নিখোঁজ ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার সকালে হাওরের পানিতে লাশ ভেসে ওঠার খবর পাওয়ামাত্র তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহ সদরের কোনাপাড়া গ্রামে শোকের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কেননা, তাঁকে নিয়ে এই একটি গ্রামেই ১৩ জন মারা গেছেন একই দুর্ঘটনায়। তাঁদের মধ্যে আবার এক বংশেরই ৮ জন রয়েছেন। অবস্থা এমন যে কোনাপাড়া গ্রামের কোনায় কোনায় শোকের আবহ। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী খরিচা গ্রামে ২ জন, গোবিন্দপুর গ্রামে ১ জন এবং গৌরীপুর উপজেলার ধোপাজাঙ্গালিয়া গ্রামের বাবা–ছেলেও রয়েছেন এ মৃতের তালিকায়।
রাকিবুলকে নিয়ে নেত্রকোনার উচিতপুরে নৌকাডুবির ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৮ হয়েছে। তাঁরা সবাই ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা। নিহত সবাই স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছিলেন। আজ সকালে সবার জানাজা শেষে দাফন হয়।
নিহতদের পরিবার ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সকালে একই গ্রামের মাদ্রাসায়ে মারকাযুস সুন্নাহ্ মাদ্রাসার মুহতামিম মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে ৩৮ জনের একটি দল নেত্রকোনার মদন উপজেলার হাওরাঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে তাঁদের সঙ্গে আরও ১০ জন যুক্ত হয়ে মোট ৪৮ জন একটি ট্রলারে করে হাওর ভ্রমণ করছিলেন। আচমকা ঢেউয়ে ট্রলারটি ডুবে গেলে ১৮ জনের মৃত্যু হয়।
দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা জাকির হোসেন এই প্রতিবেদকের কাছে বলেন, ট্রলারটি উচিতপুর ঘাট থেকে রওনা হওয়ার প্রায় ১৫ মিনিট পর হাওরের মধ্যবর্তী এলাকায় পৌঁছালে বড় বড় দু–তিনটি ঢেউ এসে নৌকাটিকে ধাক্কা দেয়। তখন আতঙ্কে সবাই ট্রলারের একপাশে চলে গেলে ট্রলারটি কাত হয়ে উল্টে যায়। ট্রলারের বাইরে থাকা সবাই ঝাঁপ দিয়ে এদিক–সেদিক সাঁতরে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু ট্রলারের ভেতরের অংশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বের হতে না পারায় মারা যান।
ঠিক একই অভিজ্ঞতা রাশেদুল ইসলাম নামের আরেক যুবকেরও। তিনি বলেন, ঘটনার সময় তিনি ট্রলারের ছাদে ছিলেন, তাই লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পেরেছেন। পরে স্থানীয় ব্যক্তিরা ঘটনাস্থলে এসে সবাইকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের দল এসে মৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছে এই ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে ইয়াসিন আরাফাত নামের এক ব্যক্তি বলেন, নেত্রকোনার মদন উপজেলার তেলিগাতি টেংরা মাদ্রাসার মুহতামিম শফিকুল ইসলামের আমন্ত্রণে এই মাদ্রাসার ৩৮ জন শিক্ষক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিলে সফরে যান। সেখানে দুপুরে খাবার খাওয়ার কথা ছিল। তার আগে দুই ঘণ্টার জন্য হাওর দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা।
একই বংশের ৮ জনের মৃত্যু
এই দুর্ঘটনায় মাদ্রাসাটির মুহতামিম মাহফুজুর রহমানসহ (৪৫) তাঁর পরিবারের ৮ সদস্য মারা গেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে দুই ছেলে মাহবুবুর রহমান (১৫) ও মাহমুদ মিয়া (১২), দুই ভাতিজা মো. জুবায়ের (২২) ও মুজাহিদ মিয়া (১৮), দুই ভাগনি জুলফা আক্তার (৭) ও লুবনা আক্তার (১০) এবং এক ভাগনে রেজাউল করিম (১৬)। তাদের একসঙ্গে নতুন একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
ছেলে হারিয়ে কবরস্থানের জন্য জমি দান করলেন বাবা
এই নতুন কবরস্থানের জমি গতকাল রাতেই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে দান করেছেন ইদ্রিস আলী নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। কেননা, এই দুর্ঘটনায় তিনিও তাঁর বড় ছেলে হামিদুল ইসলামকে (৩৫) হারিয়ে শোকাহত। সেই শোক থেকেই তিনি তাঁর বাড়ির সামনের তিন কাঠা সমপরিমাণের কৃষিজমিটি কবরস্থানের জন্য দান করেন। তাঁর ছেলেকেও এখানে দাফন করা হয়।
চর সিরতা ইউনিয়নের পুরো এলাকার সবাই শোকবিহবল এবং প্রচুর মানুষ ভিড় জমিয়েছিল নিহতের পরিবারের স্বজনদের সান্ত্বনা জানাতে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও নিহতদের পরিবারগুলোর প্রতি শোক প্রকাশ করেন।