এক পরিবারের ১১ জনকে হত্যা

কোথায়, কার কাছে গেলে বিচার পাবেন বিমল শীল

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুরে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ১১ জনের শ্মশানের সামনে বেঁচে যাওয়া বিমল শীল। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে গ্রামের বাড়িতে
সংগৃহীত

১৮ বছর আগে মা-বাবাসহ পরিবারের ১১ সদস্যকে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার বিচারের জন্য আদালতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত বেঁচে যাওয়া একমাত্র সদস্য বিমল শীল। আদৌ বিচার পাবেন কি না, সংশয়ে আছেন তিনি। এত বছরেও বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশ বিমল শীল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা এ ঘটনায় কোথায়, কার কাছে গেলে বিচার পাব, জানি না।’

আজ বৃহস্পতিবার চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় সংখ্যালঘু পরিবারের ১১ জনকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাচক্রে সেদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ওই পরিবারের এক সদস্য বেঁচে যান। বিমল শীল সেই একজন।

তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। ৫৭ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। ৩৮ আসামির সবাই জামিনে। বছরের পর বছর শুধু মামলার তারিখ পড়ছে। কিন্তু সাক্ষীরা হাজির হচ্ছেন না। স্বজন হত্যার সাক্ষী হবেন, সেই আশায় আদালতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যান মামলার বাদী বিমল শীল। আগামী বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ রয়েছে।

ঘটনার দিন রাতে বাঁশখালীতে পুড়িয়ে মারা হয় বিমল শীলের বাবা তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), মা বকুল শীল (৬০), ভাই অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২) এবং অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল। বিমল শীলের চাচাতো বোন বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), এনি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা তাঁর খালু দেবেন্দ্র শীল (৭২)। পল্লিচিকিৎসক বিমল শীল সেদিন লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার পর থেকে তিনি বাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে থাকছেন। খালি পড়ে আছে ভিটেমাটি। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

আজ দুপুরে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেওয়া হয়। শ্মশানের সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন বিমল শীল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে গেলে শ্মশানের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারি না, স্বজনদের হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। হত্যাকারীদের শাস্তি হলে তাঁদের আত্মা শান্তি পেত।’

দেশে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও হত্যার বিচার হচ্ছে না, এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিচার না হওয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে। দ্বিগুণ উৎসাহে তারা এসব ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এতে সংখ্যালঘুরা চরম নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতায় ভুগছে।

স্মৃতিস্তম্ভের সামনে বিমল শীলসহ স্বজনেরা

সরকারের কাছে তিনি দাবি জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা দরকার। এ জন্য তাঁরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। শিগগিরই তাঁরা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন পাসের জন্য সরকারের কাছে স্মারকলিপি দেবেন বলে জানান রানা দাশগুপ্ত।

আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার ২৫ মাস পর পুলিশের দেওয়া প্রথম অভিযোগপত্রে বাঁশখালীর বিএনপি নেতা আমিনুর রহমানের নাম বাদ দেওয়া হয়। বাদী নারাজি দিলে আদালত পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর পুলিশ আবারও আমিনুরকে বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এবারও বাদী নারাজি দেন। সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আমিনুরসহ ৩৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।

তবে আমিনুরের দাবি, রাজনীতি করার কারণে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁর নাম জড়ানো হয়। এর মধ্যে এক আসামির নাম রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
১৮ বছরেও কেন আলোচিত এ মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি লোকমান হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকা, বিচারকশূন্যতা ও সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় দেরি হচ্ছে। আগামী ধার্য দিনে সাক্ষীদের হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষের চেষ্টা রয়েছে। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।