হেপাটাইটিস

কোটি রোগী, সচেতনতা কম

এই রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এখনো কম। আবার চিকিৎসা ব্যয়ও বেশি।

জটিল জন্ডিস রোগ শতভাগ সারানোর নিশ্চয়তা—এমন বিজ্ঞাপন হয়তো অনেকের চোখে পড়বে। ‘ঝাড়ফুঁক’ দিয়ে জন্ডিস সারিয়ে তোলার আশ্বাস দেওয়া কথিত বৈদ্য–কবিরাজের কথাও শুনে থাকবেন অনেকে। রোগটি আসলে হেপাটাইটিস বি। বেশির ভাগ মানুষের কাছে এই রোগ ‘জন্ডিস’ নামে পরিচিত। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে এই রোগ সারিয়ে তোলার আশ্বাস দিয়ে কিছু ব্যক্তি অবৈধভাবে টাকা অর্জনের পথ খোঁজেন। আর চিকিৎসার নামে রোগীর জন্য মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করেন।

মূলত সচেতনতার অভাবে বহু মানুষ হেপাটাইটিসের চিকিৎসার জন্য ‘ঝাড়ফুঁক’–এর আশ্রয় নেন। কথিত বৈদ্য-কবিরাজের পেছনে টাকা ঢালেন এবং রোগটি জটিল পর্যায়ে নিয়ে যান। অবশ্য হেপাটাইটিসের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু হেপাটাইটিস বি পরীক্ষার পেছনে ব্যয় হয় মাথাপিছু ৮৫ হাজার টাকা; যা মেটানোর সামর্থ্য অনেকেরই নেই।

চিকিৎসকেরা বলছেন, দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৮৫ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) একটি লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি নির্মূল করা। যদিও এখন পর্যন্ত দেশের মাত্র ২০টি জেলায় সরকারি উদ্যোগে হেপাটাইটিস চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, হেপাটাইটিস থেকে সুরক্ষায় দেশজুড়ে এ রোগের চিকিৎসার বিস্তৃতির বিকল্প নেই।

হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে কী কী কর্মসূচি নিয়েছে, সম্প্রতি তার একটি তালিকা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)। সেখানে বলা আছে, হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কর্মকৌশলের একটি খসড়া তৈরি হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি। কারণ, এ রোগের চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে হেপাটাইটিস শনাক্তকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার পরামর্শ তাঁর। চিকিৎসাব্যবস্থার প্রসারের পাশাপাশি হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় কর্মকৌশল নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

* দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৮৫ লাখ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। * জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার আওতায় আসে না। * হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত পাঁচ লাখ মানুষকে যদি ছয় বছর চিকিৎসা দেওয়া হয়, তবে চিকিৎসা ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

হেপাটাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সঙ্গে যৌথভাবে ২০১৮ সালে ‘কস্ট অ্যাসেসমেন্ট অব হেপাটাইটিস বি রিলেটেড হেপাটাইটিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা করে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। গবেষণাটি প্রকাশিত হয় দিল্লিভিত্তিক সাময়িকী ইউরোএশিয়ান জার্নাল অব হেপাটো–গ্যাস্ট্রোএনটেরিলোজিতে।

গবেষণায় দেখা যায়, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত পাঁচ লাখ মানুষকে যদি ছয় বছর চিকিৎসা দেওয়া হয়, তবে চিকিৎসা ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। হেপাটাইটিস বি হওয়ার পর যাদের লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে (ক্রনিক লিভার ডিসিস–সিএলডি), তাদে মাথাপিছু চিকিৎসা ব্যয় আড়াই থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা।

হেপাটাইটিস রোগ নিয়ে দেশে নানা কুসংস্কার আছে। যে কারণে রোগীদের একটি বড় অংশ বৈদ্য-কবিরাজদের কাছে চিকিৎসার জন্য যায়। এখানে আর্থিক সামর্থ্যেরও একটা বিষয় কাজ করে। এ রোগের চিকিৎসায় বিপুল ব্যয়ের জন্য সরকারি সহায়তা দরকার। যেটি দেশে অনুপস্থিত।
নজরুল ইসলাম, সাবেক উপাচার্য, বিএসএমএমইউ

এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ এ রহিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হেপাটাইটিসের রোগীদের বড় অংশ চিকিৎসার খরচ চালাতে পারে না। সাধারণ মানুষ ওষুধ কিনতে পারে না। শহরাঞ্চলের রোগীরা চিকিৎসা কিছুটা নেয়। কিন্তু যখন পারে না, তখন তারাও ঝাড়ফুঁকের দিকে যায়। আর জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার আওতায় আসে না।’

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশই জানে না তাদের এ রোগ আছে। তাই বিপদ আরও বেশি। এর জন্য মাঠপর্যায় থেকে রোগী শনাক্ত, চিহ্নিত করা দরকার। দরকার ভবিষ্যতের রোগ প্রতিরোধের জন্য কর্মকৌশল ঠিক করা। তবে এ ধরনের উদ্যোগ সরকারের তরফে নেই।

বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হেপাটাইটিস রোগ নিয়ে দেশে নানা কুসংস্কার আছে। যে কারণে রোগীদের একটি বড় অংশ বৈদ্য–কবিরাজদের কাছে চিকিৎসার জন্য যায়। এখানে আর্থিক সামর্থ্যেরও একটা বিষয় কাজ করে। এ রোগের চিকিৎসায় বিপুল ব্যয়ের জন্য সরকারি সহায়তা দরকার। যেটি দেশে অনুপস্থিত।

হেপাটাইটিসের প্রতিকার ও প্রতিরোধে কয়েকটি উপায়ের কথা বলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে আছে সচেতনতা বৃদ্ধি, পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি, সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা। প্রতিকারের চেয়ে রোগ প্রতিরোধে বেশি দৃষ্টি দেওয়া দরকার।