সাহেরা বেগম তখনো ছেলে সাজুর মুখটা দেখেননি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ঠিক কোন জায়গায় সাজু আছে তাও তিনি জানেন না। প্লাস্টিক ডোরের বাইরে থেকে ছেলেকে একটিবার দেখার কত যে চেষ্টা মায়ের।
সাহেরা একা নন। বুধবার বিকেলে কেরানীগঞ্জের প্রাইম-প্লেট প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে পোড়া মানুষগুলোর স্বজনদের প্রত্যেকের একই অবস্থা। কেউ চিৎকার করে কাঁদছেন, কেউ কাঁদছেন ডুকরে।
স্বজনের কাছে যতটা সময় থাকা যায় তার আকুতি সকলের। দগ্ধ হওয়ার তালিকায় ১৪ বছরের কিশোর আসাদ, ১৬ বছরের জিহান ও রায়হানসহ আছেন ৩৪ জন। তাঁদের ৩২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের অনেককেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করতে হবে বলে জানাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
রোকেয়া বেগমের দুই ভাই। ছোট্টবেলায় মা মারা যাওয়ার পর তিনিই ভাই দুটোকে মানুষ করেছেন। দুই ভাই রাজ্জাক ও আলম। কারও অবস্থাই ভালো না। গোটা শরীর পুড়েছে ওদের, চোখ গলা। দেখতে পায় না কিছুই। ফয়সালের বোন হামিদা বেগম ডুকরে কাঁদছিলেন। ভাইয়ের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। ফয়সাল অসুস্থ এটুকু জানিয়েছেন, কতক্ষণ তার এভাবে পুড়ে যাওয়ার তথ্য লুকিয়ে রাখতে পারবেন জানেন না।
সাহেরার কষ্ট সেই ১৪-১৫ বছর বয়সে সংসারের খরচ মেটাতে ছেলেটাকে কারখানায় পাঠানোয়। কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে সব গেছে। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে কেরানীগঞ্জে চলে এসেছিলেন বছর পাঁচেক আগে। সাজু তখন থেকেই সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টার কাজে যোগ দেন। এখন বেতন পান ১০ হাজার টাকা। সাহেরার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সাজুর বাবা নজরুল ইসলাম বললেন, রাতে ঘরে ফিরে ছেলেটা পড়ত, এসএসসি পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল এবার।
কেরানীগঞ্জের ওই কারখানায় আগুন লাগার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় বাসিন্দারা আহত শ্রমিকদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরিবারের সদস্যদের অনেকেই তাঁদের স্বজন-সন্তানদের খবর জেনেছেন পরে। আগুন লাগে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। আবাসিক এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কারখানাটি চলছিল। রাতের দিকে স্বজনেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের বিভিন্ন তলায় ছুটছিলেন প্রিয়জনের খোঁজে। কাঁপতে কাঁপতে দেয়ালে সাঁটানো তালিকা দেখছিলেন কেউ কেউ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তি রোগীদের ষাট শতাংশই মারাত্মক খারাপ। সাধারণত অগ্নিদগ্ধ রোগীরা হাসপাতালে এসে কি করে পুড়ে গেছেন, কীভাবে আগুন লাগল বলেন। আজ (বুধবার) ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থা খুব খারাপ। প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়েছে। সংখ্যায় ৩২ জন। অন্য দুজনের পা পোড়া। চিকিৎসকেরা জানান, রোগীদের শরীরের কতটুকু পুড়েছে তা ঠিকমতো মূল্যায়ন করতে পারেননি তাঁরা। কারও কারও শতভাগ পুড়েছে, কারও ৭০-৯০ শতাংশ, কারও ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত। প্রত্যেককেই আসা মাত্রই ব্যান্ডেজে মোড়া হয়েছে। চুল পর্যন্ত পোড়া। বৃহস্পতিবার রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরিষ্কার বলা যাবে।
রোগীর স্বজনেরা বুধবার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে নানা অভিযোগ করেন। কামরুন্নাহার হুরি নামের এক নারী বলেন, তাঁর স্বজনরা কারখানায় কাজ করতেন, পাশেই একটা বাসায় থাকতেনও তাঁরা। অগ্নিকাণ্ডে বাসাতেও আগুন লেগে যায়। এর আগেও কারখানাতে আগুন লেগেছে। স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল করিমও জানান একই কথা। স্থানীয় বাসিন্দারা চান এলাকা থেকে কারখানাটি সরানো হোক।
আহত যাঁরা
আসাদ (১৪), জিহান (১৬), রায়হান (১৬), দুর্জয় (১৮), ইমরান (১৮), বশির (১৮), আসলাম (১৯), সোহাগ (১৯), শহীদুল (১৯), সুজন (১৯), মেহেদী (২০), ইমরান (২০), সুমন (২২), মোস্তাকিম (২২), জাকির (২৪), ফয়সাল (২৫), সোহাগ (২৫), শওকত (২৬), বাবলু (২৬), আবু সাঈদ (২৯), ফয়সাল-২ (২৯), সাজিদ (২৯), সালাউদ্দীন (৩২), ফারুক (৩২), জিনারুল ইসলাম (৩২), খালেদ (৩৫), আলম (৩৫), ফিরোজ (৩৯), রাজ্জাক (৪০), ফিরোজ (৪০), লাল মিয়া (৪২), মফিজ (৪৫), সিরাজ (৫০) ও জাহাঙ্গীর (৫৫)।