এ বঙ্গ অঞ্চলে ইতিহাসের নানা সময়ে যেমন নানা জাতির আগমন ঘটেছে, সেই সঙ্গে আগমন ঘটেছে নানা পণ্যের, নানা খাদ্যের। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদার একটি হলো খাদ্য। বাঙালির খাদ্যতালিকায় থাকা জীবনধারণ ও রসনাতৃপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় নানা পদ একই সঙ্গে বাঙালি ও সেই সব জাতিগোষ্ঠীর খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাসকেও নির্দেশ করে।
ঈশ্বর গুপ্তের বাণী এখনো সঠিক, ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল।’ আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে বঙ্গ অঞ্চলে আমদানি হয়েছিল ধানের আর সময়ের ব্যবধানে এখন আমাদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত। বাংলা ভাষার একমাত্র আদি নিদর্শন চর্যাপদকে ভিত্তি ধরে যে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, সেই চর্যাপদেই খাদ্যশস্য হিসেবে শুধু চালের কথা উল্লেখ রয়েছে। ধান আমদানির সময়কাল জানা গেলেও খাল-বিল, নদীনালার এ অঞ্চলের খাদ্যতালিকায় মাছের অন্তর্ভুক্তি কোনো সময়কালে, তা জানা যায় না।
প্রাকৃতপৈঙ্গলের একটি পদে বলা হচ্ছে, সেই স্বামী পুণ্যবান (ভাগ্যবান) যার নারী রোজ কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর নালিতা শাক পরিবেশন করেন। বাঙালির খাদ্যতালিকার একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে ঝাল দিয়ে তৈরি খাবার বা ঝাল খাবার আর তার সঙ্গে আলু দিয়ে যে কত পদ রান্না হয় বাঙালি হেঁশেলে, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ লংকা মরিচ আর আলু বঙ্গ অঞ্চলে এনেছে পুর্তগিজরা সতের শতকে। সেই সঙ্গে পর্তুগিজরা আরও নিয়ে এসেছে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ফলমূল আর শুকনো খাবার। ইংরেজরা নিয়ে এসেছে চপ, বিস্কুট, প্যাটিস, কাটলেটের মতো মুখরোচক খাবার। দিল্লির মোগল দরবারে সুঘ্রাণ ছড়ানো মোগলাই খাবার এখন বাঙালি সাধারণের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় যে বিয়েবাড়িতে তা কাচ্চি বিরিয়ানি হয়ে যেমন জিবে জল আনে, ঠিক তেমনি শাহি হালিম হয়ে তৃপ্তির ঢেকুর ওঠায় রোজাদার বাঙালি মুসলমানের প্রতিদিনের ইফতারিতে।
অতিথিবৎসল বাঙালিদের নিয়ে বিশিষ্ট গবেষক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ‘বাঙালিরা খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসেন। বস্তুত,তাঁদের আতিথেয়তা এবং সৌজন্যের একটা প্রধান বহিঃপ্রকাশ হলো অন্যকে খাওয়ানো। কেবল নিমন্ত্রিত অতিথি নয়, বাড়িতে কেউ এলেই তাঁকে কিছু খাওয়ানো বা খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করা বাঙালি ভদ্রতার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাওয়ার সময় না-হলে অন্তত চা অথবা শরবতের মতো কোনো পানীয় অথবা নিদেন পক্ষে পান খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করাও ভদ্রতার লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়। তদুপরি, অতিথি খেলেই নিমন্ত্রণ-কর্তা খুশি হন না, অতিথিকে পেট ভরে খেতে হয়। অনুরোধে ঢেঁকি গেলা প্রবাদ এ থেকেই এসেছে কি না, কে জানে? খেয়ে হাঁসফাঁস করলে অথবা তৃপ্তির ঢেকুর তুললে তবেই নিমন্ত্রণ-কর্তা সন্তুষ্ট হন - তাতে ঢেকুর তোলা যতই অভব্য আচরণ হোক না কেন।’
বাঙালি তার আত্মীয় বাড়িতে দই-মিষ্টি, পান নিয়ে যান; মেয়ের বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পাঠানো হয় ঢাউস সাইজের রুই, কাতলা, চিতল মাছ। খুশির সংবাদে মিষ্টি বিতরণ করা হয় পাড়ায় পাড়ায়, এমনকি নবজাতকের মুখে দেওয়া হয় মধু যেন তার বাণী মধুর মতোই সুমিষ্ট হয়, বাঙালির নবান্ন উৎসব শুধু ধান কাটা আর পিঠাপুলির-ই নয়, এ সময়ে বাঙালি নারী গৃহে তৈরি করেন নতুন ধানের সুমিষ্ট পায়েস। বাঙালি নারী পরম মমতায় হাতে তৈরি করেন ঈদের সেমাই, পূজার নাড়ু-লাড্ডু। শুধু কি উৎসব, পালা-পার্বণেই ভোজ; বাঙালি শোকেও ভোজের আয়োজন করে। মৃতের আত্মার শান্তি কামনায় শয়ে শয়ে মানুষকে খাওয়ানো হয়। জিলাপির যত প্যাঁচ-ই থাকুক না কেন, জিলাপি ছাড়া কি বাঙালির মিলাদ মাহফিল হয়! বাঙালি মুসলমান ছেলের সুন্নতে খতনা, সেখানেও আছে ভোজ। বিপদ আপদ দূর করতে সদকা দেবে, দিয়ে দিচ্ছে বাড়ির হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল। অন্নপ্রাশন হবে—কেউ একা একা খায় নাকি, চতুর্পাশ থেকে স্বজনেরা এসে বাড়ি ভরবে তবেই না! জামাইষষ্ঠী সে তো বিশাল ব্যাপার, মহাআয়োজন! মেয়ে-মেয়েজামাইদের আপ্যায়ন বলে কথা। খাদ্যের সঙ্গে বাঙালির এই নিবিড় মিতালি শুধু খাদ্যাভ্যাসের বিবেচনায় দেখলেই হবে না, এর সঙ্গে অতি অবশ্যই জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয়, যা অত্যন্ত আবেগ ও ঐতিহ্যনির্ভর। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে সেই সঙ্গে বদলে গিয়েছে মানুষ।
বেড়ে গিয়েছে খাদ্যে ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য। খাদ্যে ভেজাল যেন রসনাপ্রিয় বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত পরিচয়ের ওপরই একটি আঘাত। কী খাচ্ছি আমরা? কী খাওয়াচ্ছি আমরা? আপনি আদর করে আমার পাতে কী তুলে দিচ্ছেন? আমিই বা নিখাদ ভালোবাসায় অনেক যত্ন করে আপনার পাতে কী উঠিয়ে দিচ্ছি? বাঙালি রসনার নানা জটিল রসায়নের কারিগরি উদ্ধার করা গেলেও বাঙালির পাতে ভেজাল খাবার কী উপায়ে এল, আর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর নানা ফন্দিই বা ঠিক কোথা থেকো রপ্ত হলো, তা দুর্বোধ্য। একসময় যে বাঙালি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব...
ভদ্র মোরা,শান্ত বড়ো, পোষ-মানা এ প্রাণ
বোতাম-আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি
মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্টগতি -
গৃহের পানে টান।’
সেই বাঙালির হাতে এখন সময় কোথায়? বাঙালি নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই এখন কর্মব্যস্ত। তৈরি পোশাক শিল্প খাতের অধিকাংশ শ্রমিক এখন নারী। বাচ্চা কাঁদলেই তার এখন গুড়-মুড়ি দিয়ে মোয়া তৈরির সময় কোথায়? মায়ের হাতের মোয়া এখন আর চাইলেই পাওয়া যায় না, তার বদলে মা কিনে দিচ্ছেন প্যাকেটজাত আলুর চিপস। অথচ এই আলুকেই বাঙালি মেয়েরা একসময় পাতলা করে কেটে রোদে শুকিয়ে গরম ডুবোতেলে ভেজে কী নান্দনিকভাবেই না পরিবেশন করতেন! পয়লা বৈশাখ, বাড়িতে অতিথি নিমন্ত্রণ করেছেন, সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে এত কিছু রান্নার সময় কোথায়? সরষে দিয়ে ইলিশ মাছ করলেন অথবা নুন, মরিচ আর হলুদ দিয়ে মাছটাকে খুব সুন্দর করে ভেজে নিলেন আর বাদবাকি খাবারগুলো আনিয়ে নিলেন পরিচিত কোনো ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে। ঈদে হাতের সেমাই তৈরি করতে গেলে যে সময় আর শ্রমের দরকার হয়, তা করতে গেলে গৃহের বাদবাকি কাজগুলো সামাল দেবে কে;আর এই সময়ে গৃহকর্মীর সহযোগিতা মেলাও ভার। তাদেরও তো ঈদ আছে, বাড়ি আছে। এত ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে কিনে নিলেন প্যাকেটজাত লাচ্ছা সেমাই।
আদরের সোনামণির জন্মদিনে গরুর দুধ দিয়ে পায়েস রান্না করবেন, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বাবার বাড়িতে গোয়ালভরা গরু থাকলেও লাভ নেই। আপনি তো স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামে নিবাস গড়েছেন, বাধ্য হয়েই রান্নায় ব্যবহার করছেন বাজার থেকে কেনা দুধ। ইউটিউবে কুমড়োর বড়ি কীভাবে বানাতে হয়, তা দেখেছেন ঠিকই কিন্তু ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাসায় উঠান কোথায় আর সে সময়-ই বা আপনার কোথায়। রাস্তায় মানুষ আর যানবাহনের ভিড়ে আপনার অবসর হারিয়ে যায়। এর চেয়ে মোড়ের দোকানে কুমড়োর বড়ি কিনতেই পাওয়া যায়, সেই ভালো। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে বড় সাধ করে মাছ পাঠাবেন, আপনার সেই পুকুর কোথায়, এর চেয়ে বরং কিনে নিলেন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা বাজারের সবচেয়ে বড় দুটো রুই আর চিতল। বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত করে খাওয়াবেন। সারা দিন অফিস আর নানাবিধ কাজের চাপে হয়ে উঠছে না। সেই সঙ্গে ফ্ল্যাট বাসায় এতগুলো মেহমান একসঙ্গে দাওয়াত করা আরেক মুশকিল, এর চেয়ে বেছে নিলেন আপনার সাধ আর সাধ্যের মধ্যে কোনো রেস্তোরাঁ। ব্যস হয়ে গেল জম্পেশ আড্ডা আর সেই সঙ্গে খানাপিনা, রান্নাবান্না করার কোনো ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই।
সময় আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে খাদ্যে ভেজালকারীরা। মহামান্য হাইকোর্টে যে ৫২টি নিম্নমানের পণ্যের তালিকা উঠেছিল, তার মধ্যে রয়েছে সরিষার তেল, চিপস, খাওয়ার পানি, লবণ, হলুদ গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, লাচ্ছা সেমাই, সুজি, বিস্কুট, ঘি, দই, কারি পাউডার, নুডলস, মধু। এর বাইরেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে চমকপ্রদ সব নেতিবাচক তথ্য। চালের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে অ্যারারুট। চাল সাদা করতে দেওয়া হচ্ছে সোডিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড, ওজন বাড়াতে মেশানো হচ্ছে গুঁড়া পাথর, কাঁকর, ইটের গুঁড়া। চালকে কয়েকবার সেদ্ধ করাতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ভিটামিন-বি। ভেজাল চাল শুধু ক্ষুধামান্দ্য, পেটের পীড়ার জন্যই দায়ী না, এটি আমাদের ফুসফুস, কিডনি, লিভারের জন্যও ক্ষতিকর। দুধে মেশানো হচ্ছে পানি ও ময়দা। খাঁটি দুধের সঙ্গে সয়াবিন তেল, চিনি ও রং মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে দুধ। দুধের ছানায় দেওয়া হচ্ছে ফরমালিন। কাঁচা আম কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে বিক্রি হচ্ছে, ফলে এবং মাছে দেওয়া হচ্ছে ক্ষতিকর মাত্রার ফরমালিন। অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশে কারাখানার রং দিয়ে তৈরি হচ্ছে মিষ্টি। নামীদামি ফুডকোর্টগুলো বিক্রি করছে পচা-বাসি খাবার। দীর্ঘদিন আগের গরুর মাংস তাজা দেখাতে মেশানো হচ্ছে রং। মহিষের মাংস বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস বলে। চায়নিজ রেস্তোরাঁর খাবারে মিলছে তেলাপোকা। জিলাপির খামিতে দেওয়া হচ্ছে ক্ষতিকর হাইড্রোজ। রাইস মিলের আড়ালে গড়ে উঠেছে নিম্নমানের তেল, সাবান, জুস উৎপাদন কারখানা। নোংরা পরিবেশে পোড়া তেলে তৈরি হচ্ছে লাচ্ছা সেমাই। জালিয়াতি চক্র নামীদামি কোম্পানির মোড়কে ভরে দিচ্ছে নকল চিপস। খাবার উৎপাদনের তারিখ পরিবর্তন করে কারখানা থেকে বিক্রির জন্য যাচ্ছে দই। হলুদে মেশানো হচ্ছে রং।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘বাঁশবন’ রচনায় লিখেছেন, ‘আমি ইংরেজি জানি নে। মুসলমান মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি, শুয়োরের মাংসের নাম ইংরেজিতে ‘পর্ক’ এবং ওটা খাওয়া মহাপাপ। তাই ‘পর্কচপ’ না-খেয়ে আশ্বস্ত হতুম, ধর্মরক্ষা করেছি। তার পর একদিন আবিষ্কার করলুম, ‘হ্যাম’, ‘বেকন’ শুয়োরের মাংস, এমনকি ওই মাংসের কাটলেট, সসেজও হয়-এবং মেনুতে তার উল্লেখও থাকে না। আবিষ্কারের পর অহোরাত্র জল স্পর্শ করিনি এবং মোল্লাবাড়িতে গিয়ে ‘তওবা’ অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্ত করেছিলুম। মোল্লা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন ‘অজান্তে খেলে পাপ হয় না’। কিন্তু আমার পাপিষ্ঠ মন চিন্তা করে দেখলে, অজান্তে খেলেও স্বাদে ভালো লাগতে পারে।’ আপনি বাংলা, ইংরেজি দুটোই জানুন তা বিশেষ কাজে দেবে না যদি কুকুরের মাংসকে খাসির মাংস বলে বিক্রি করা হয়। নরসিংদীতে ২০১৪ সালে কুকুরের মাংস বিক্রির দায়ে মাসুদ কামাল নামে এক ব্যবসায়ীকে দণ্ড দিয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মাসুদ শহরের খাবার হোটেলগুলোতে খাসির মাংস হিসেবে কুকুরের মাংস সরবরাহ করে আসছিলেন। কৃষিপণ্য উৎপাদনে, বিপণনে লাগামহীনভাবে ব্যবহার হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য। গরুকে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মোটাতাজা করে অতি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে স্টেরয়েড গ্রুপভুক্ত ডাইকোফ্লেনাক, ওরাডেক্সন, স্টেরন, ডেক্সাসন, এডাম কোরটান, কোরটিজল, হাইড্রো কোরটিজল ইত্যাদি ওষুধ এবং ইউরিয়া খাওয়ানো হচ্ছে। ফার্মের মুরগিকে যেসব খাবার খাওয়ানো হচ্ছে, তাতে রয়েছে আর্সেনিক। এই খাদ্য খাওয়ানোর পরে আর্সেনিক সম্পূর্ণভাবে হজম না হয়ে সংক্রমিত হচ্ছে মুরগির মাংসে। আর এ মাংস খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা চলে আসছে মানবদেহে। চাষের মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মুরগির বিষ্ঠা ও আবর্জনা। মাছের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কিংবা রোগ-বালাই সারাতে ব্যবহার করা হচ্ছে সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক। এসব ক্ষতিকর উপাদান রোজকার খাবারের সঙ্গে গিয়ে প্রবেশ করছে মানব শরীরে, যা কিডনি, ফুসফুস,যকৃতের ক্ষতি করার মাধ্যমে জীবনকে করে তুলছে ঝুঁকির সম্মুখীন। আমাদের শরীরকে করে তুলছে বিভিন্ন জটিল ব্যাধির জন্য উর্বর। কিন্তু কেন এই খাদ্যে ভেজাল? যিনি ক্ষতিকর ফরমালিনযুক্ত আম বিক্রি করছেন, তিনিই তো আবার চাষের মাছ খাচ্ছেন, যিনি মুরগির বিষ্ঠা খাইয়ে মাছ চাষ করছেন তিনি কি ক্ষতিকর উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খাচ্ছেন না? তাহলে আমরা এ কোন গোলকধাঁধায় আটকা পড়লাম। তাই আমাদের শুধু অপরাধের ধরন নিয়ে ভাবলেই হবে না, অপরাধের কারণ বোঝার চেষ্টাও করতে হবে।
রবার্ট কে মার্টনের মত অনুযায়ী যে সমাজে পন্থা বাদ দিয়ে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয় এবং উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমাজস্বীকৃত উপায় সবার জন্য সমানভাবে বণ্টিত হয় না, সেই সমাজে অনেক ব্যক্তি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হাসিলে সমাজ বহির্ভূত বা অস্বীকৃত পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করে। সিগমন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের ব্যক্তিত্ব তিনটি বিশেষ সত্তা দ্বারা গঠিত। এগুলো হলো ইড, ইগো এবং সুপার ইগো। ইড মানুষকে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করতে এবং সুখভোগ করতে যেকোনো পন্থা অবলম্বনে ক্রিয়াশীল করে। ইগো ব্যক্তিকে তার সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ করে দেয়। সুপার ইগো ইডের অনৈতিক চাহিদাকে নৈতিক মানদণ্ডের আলোকে বাধা দেয়।
সুপার ইগো হচ্ছে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের নৈতিক আদর্শ বা সামাজিক উপাদানের দিক। ব্যক্তির মধ্যে ইগো বিশেষ করে সুপার ইগো যত বেশি করে ক্রিয়াশীল থাকবে, ব্যক্তির পক্ষে ইডকে প্রাধান্য দিয়ে নিজ সুখের জন্য স্বেচ্ছাচারমূলক বা সমাজবিরোধী কাজ করা তত কঠিন হবে। আমরা কি খাদ্যের ব্যবসায় সহজে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করার জন্য, ব্যবসায় দ্রুত সফল হওয়ার জন্য, ব্যবসায় ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কিংবা অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য ‘ইড’কে জিতিয়ে দিচ্ছি না? তবে আমাদের উচিত হবে ব্যক্তির নৈতিক আদর্শের ভিত্তিকে মজবুত করার কাজে মনোনিবেশ করা। আইনের কঠিন ও কঠোর প্রয়োগ হয়তো ইগোকে শক্তিশালী করবে কিন্তু টেকসই সমাধান হলো সুপার ইগো গঠনে মনোনিবেশ করা। যে সুপার ইগো সামষ্টিক কল্যাণের জন্য নিজে থেকেই নিবেদিত, যে সুপার ইগো সবাইকে নিয়েই জিততে চায়। আর যদি মার্টনের কথায় ফিরে যাই, তাহলে আমাদের এমন সমাজ গড়তে হবে, যে সমাজ সাফল্য নয় বরং সাফল্যলাভের উপায়কে উদযাপন করে। যে সমাজ সাফল্য কী উপায়ে এসেছে তাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়, যে সমাজ ব্যর্থ হলেও সৎ প্রচেষ্টাকে মূল্যায়ন করে। আমাদের মনোযোগ থাকতে হবে এমন সমাজ গঠনের প্রতি, যে সমাজে সুযোগ সবার জন্য সমভাবে বণ্টিত হয়, কেননা সুযোগের অসম বণ্টন সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করে। আমরা কতটুকু উপার্জন করতে পারছি, তার থেকে ‘কী উপায়ে উপার্জন করছি?’ এই প্রশ্নটির মধ্যেই রয়েছে সমাধান, সামষ্টিক কল্যাণ। তাই খাদ্যে ভেজাল রোধে শুধু ভেজালবিরোধী আইনের প্রয়োগের মধ্যেই সমাধান খুঁজলে হবে না, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি। প্রয়োজন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কিছুদিন পূর্বে জাপান সফরে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর একটি নিবন্ধে জানিয়েছেন, জাপান তাঁর হৃদয়ের কাছাকাছি। জাপান মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছেছে তার সততা, কর্মনিষ্ঠা, শুদ্ধতার গুণে। জাপানিরা কাজপাগল জাতি। তারা শুধু তাদের কাজটি সম্পন্ন করেই ক্ষান্ত হয় না, তারা কাজের মানের প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধাশীল। তারা নিজের দেশের এবং বাইরের দেশের মানুষকে সব সময় তাদের সেরাটাই দেয়। জাপানিদের এই যে শুদ্ধতা, সততা, সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা, এটিই বিশ্বব্যাপী জাপানি পণ্যের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডিং। চিংড়িতে জেলি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ির ওজন বৃদ্ধি করার মানসিকতা নিয়ে এই ব্র্যান্ডিং অর্জন করা সম্ভব হবে না। শিল্পী শচীনদেব বর্মন তাঁর একটি বিখ্যাত গানের কথায় লিখেছেন—
বাংলা জনম দিলা আমারে।
তোমার পরান আমার পরান
এক নাড়িতে বাঁধারে।
বাংলা জনম দিলা আমারে।
মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারো নাই
সব ভুলে যাই,তাও ভুলি না
বাংলা মায়ের কোল।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একটি দেশের সন্তানেরাই সেই দেশের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এই দেশের সন্তানেরা মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে লাখ লাখ বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছে একটি বৃহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, তৈরি করেছে মহান আত্মত্যাগের অবিস্মরণীয় ইতিহাস। তাঁদের সেদিনের সেই রক্তাক্ত আত্মবিসর্জন আমাদের দিয়েছে ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। এই মহান আত্মত্যাগ, এই ভৌগোলিক স্বাধীনতা যথার্থ পূর্ণতা পাবে বাঙালির আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং অর্জনের মাধ্যমে আর এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ-সবল জাতি গঠনের। একটি সুস্থ, সবল জাতিই পারে সব শৃঙ্খল, প্রতিকূলতা ছিন্নভিন্ন করে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। তাই খাদ্যে ভেজাল রোধ করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুস্থ সবল, কর্মঠ ও পরিশ্রমী জাতি গঠনের বিকল্প নেই। খাদ্যে ভেজাল রোধ করে নিরাপদ খাদ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গড়ে তোলা সুস্থ-সবল, কর্মঠ, পরিশ্রমী প্রজন্মই জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে উড়াবে গান্ডীব, পায়ের কাছে নামাবে পাহাড়।
*মো. আরাফাত আজাদ: প্রভাষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজ, লালমনিরহাট