কেউ পাচ্ছেন না কারও খবর, ধানের গোলায় পানি

নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন সিলেট নগরের বাসিন্দারা। আজ শনিবার সকালে নগ‌রের শাহজালাল উপশহর এলাকায়
ছবি: মানাউবী সিংহ

মা, ভাই, বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য সৃষ্টিকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না যুঁথি দেব। কারণ, সিলেট এখন বিচ্ছিন্ন পুরো দেশের সঙ্গে। সেখানে সিলেটের মেয়ে যুঁথি দেব তো থাকেন কয়েক হাজার মাইল দূরে। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী যুঁথি জানান, দুদিন আগে বোনের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হওয়ারও এক দিন আগে মায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছিল। যুঁথির মতো একই দশা সিলেটের বাইরে থাকা অন্যদেরও। তাঁরাও সিলেটে অবস্থান করা পরিবারের সদস্যদের খোঁজ পাচ্ছেন না।  

ইস্ট লন্ডনের বো শহর থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে যুঁথি বলন, ‘দুদিন আগে বোনের সঙ্গে যখন কথা বলি, তখন বিশ্বনাথে ওদের ঘরের ভেতরে বন্যার জল খাট স্পর্শ করেছে। ওই সময় তারা বাসার সবকিছু সরিয়ে নিচ্ছিল। এর এক দিন আগে থেকেই মায়ের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। আমার ভাইয়ের সঙ্গে মা থাকেন সিলেটের কামালবাজারে। কোনোভেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। আশপাশের বাসায় ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। তিন দিন হলো জানি না মা আসলে কেমন আছেন বা কোথায় আছেন। এ অবস্থায় সন্তান হিসেবে আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছেন। এখন শুধু বসে বসে প্রার্থনা করছি।’

ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় বুক সমান পানি। বুক সমান পানি ঠেলে রিকশায় যাতায়াত করছেন মানুষজন। আজ দুপুরে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের সামনে

যুঁথি জানান, তাঁর মা মাধুরী দেবের (৬০) সঙ্গে তাঁর মেয়েদের যোগাযোগ হয়েছে সর্বশেষ তিন দিন আগে। ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিকে নিয়ে মাধুরী দেব কেমন আছেন, জানতে পারছেন না তাঁর অন্য সন্তানেরা।

যুঁথি আরও জানান, তাঁর এক বোন রিমা দেব থাকেন সিলেটের বিশ্বনাথে। গতকাল শুক্রবার ভোরে রিমাদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয় তাঁর। এরপর থেকে তাঁরাও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়েছেন বলে জানালেন যুঁথি।

এদিকে আজ শনিবার সারা দিন পর সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ পেয়েছেন সিলেটের কুমারপাড়ার কিছু মানুষ। এ এলাকা সামান্য উঁচু থাকায় এখানে এখন পর্যন্ত ঘরের ভেতর পানি ওঠেনি। তাই অন্যান্য জায়গার বন্যাকবলিত অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন এই এলাকায় থাকা আত্মীয়ের বাড়িতে।

সাংবাদিক মোহাম্মদ মোহসিন কুমারপাড়ার বাসিন্দা। প্রথম আলোকে তিনি জানান, কুমারপাড়ায় তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়রা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সুবিদবাজার, মদিনা মার্কেটসহ দক্ষিণ সুরমার কয়েকটি জায়গায় আংশিকভাবে বিদ্যুৎ–সংযোগ ফিরেছে। তবে ঘরের ভেতর পানি থাকার ফলে অনেকেই ভয়ে ফোন চার্জ দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন না।

আজ দুপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সিলেটের খরাদিপাড়ায়। বন্যার পানিতে ডুবে থাকা টেলিভিশনের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটে টিটু চৌধুরী নামের এক যুবকের। রাত নয়টা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ সৎকারের কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টিটু চৌধুরীর রাজনৈতিক সহকর্মী আলম খান প্রথম আলোকে জানান, বন্যার পানির জন্য কোথাও যাতায়াত করা যাচ্ছে না। ফলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা টিটুর মরদেহ এখনো শাপলাবাগের বাড়িতেই রাখা হয়েছে। টিটুর মা দিরাইয়ে নিজেদের বাড়িতে ছেলের মরদেহ নিয়ে যেতে চাইলেও কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।

অপূর্ব শর্মার বাড়ি সিলেটের জিন্দাবাজারে। দুপুরে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলে ১০ মিনিটের মধ্যে তাঁদের পুরো এলাকা ডুবে যায়। ঘরের ভেতর ৯ ইঞ্চির মতো পানি উঠেছে বলে জানান অপূর্ব। তিন বছরের বাচ্চাসহ তাঁর পরিবারে আছে বয়স্ক মানুষ।

অপূর্ব জানান, আজ সারা দিন বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন থাকার পর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে তাঁদের এলাকায় বিদ্যুৎ আসে। কিন্তু শিশু, বৃদ্ধ নিয়ে পানিবন্দী ঘরের ভেতর আটকে আছে তাঁর পরিবারের মতো ওই এলাকার কয়েক শ মানুষ।

অপূর্ব আরও জানান, ‘দুপুরে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। চৌহাট্টার শহীদ মিনার সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সেখানে পানি উঠেছে আজ দুপুরে।

ছোট বাচ্চা, বৃদ্ধ নিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। আমাদের অনেক আপনজনেরই খবর জানি না। কোথাও সরে যাওয়ারও সুযোগ পাইনি।’

এদিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের উত্তর বড়দল ইউনিয়নের বন্যাকবলিত মানুষজন বলছে, ২০০৪ সালের বন্যাতেও তাঁদের এলাকায় এত পানি ওঠেনি। এখানকার মানুষের খাবারের পানি আনতে হচ্ছে সাঁতরে গিয়ে ইউনিয়নের শেষ মাথার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে।

উত্তর বড়দলের বাসিন্দা সালেহ ফুয়াদ থাকেন রাজধানী ঢাকায়। বাড়িতে তাঁদের ধানের গোলা স্পর্শ করেছে বন্যার পানি।

প্রথম আলোকে ফুয়াদ বলেন, ‘দুদিন ধরে বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। কে কোথায় আছে জানি না। গত পরশু রাতে বাড়িতে পানি প্রবেশ করে ধানের গোলা স্পর্শ করেছে। তখন শেষ কথা হয়েছে সবার সঙ্গে। এখন বাড়ির আশপাশের কাউকে মোবাইল ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। ধানের গোলায় পানি উঠলে দুই থেকে চার দিনের মধ্যে চারা গজিয়ে যাবে। এটাই ছিল সারা বছর চলার একমাত্র ফসল। আমার বড় বোনের বাড়ি টাঙ্গুয়ার হাওরে। তাদের সঙ্গে আজ বিকেলে একবার যোগাযোগ হয়।

কিন্তু তাহিরপুরের বাড়ির খবর পাইনি। টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থাও খারাপ। সারা বছর এখানে পানি থাকলেও এবারের বন্যার পানিতে যে বড় বড় ঢেউ হয়েছে, কেউ নৌকাও ব্যবহার করতে পারছে না।’

এদিকে আজ সিলেট নগরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পাহাড়ি ঢল আর প্রবল বৃষ্টিতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১টার মধ্যে নতুন করে নগরের অন্তত ২৫টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নগরের বাসিন্দারা যে যেদিকে পারছেন, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন।

প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আজ সকালে সিলেট নগরের প্রায় ২০টি এলাকা ঘুরে তিনি দেখেন, প্রায় সব কটি এলাকা এবং সড়কে উঠেছে পানি। এর মধ্যে শাহজালাল উপশহর, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, নাইওরপুল, মিরাবাজার, টিলাগড়, শেখঘাট, তালতলা, মাছুদিঘির পাড়, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, দাড়িয়াপাড়া এলাকার সড়কে এবং বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে।