মা তাঁর কন্যাশিশুকে পত্রিকার খবর দেখাচ্ছেন।
‘জানো মামণি, এই দেখো পাথফাইন্ডারের ছবি। এটা এখন দূরের মঙ্গল গ্রহে চরে বেড়াচ্ছে।’
‘এটা কী?’
‘নভোযান।’
‘কে চালাচ্ছে?’
‘রিমোটে চলে, তোমার খেলনা গাড়ি যেমন রিমোটে চলে, ওই রকম। দূর থেকে সংকেতে চলে। আর এটা চলে মঙ্গল গ্রহে। পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা সংকেত পাঠান।’
‘মা, গ্রহ কী?’
এইভাবে মা তাঁর মেয়েকে শোনাচ্ছেন বিজ্ঞানের, মহাকাশের, স্পেস মিশনের, রোভারের কথা—যে রোভার দূর থেকে রিমোট সংকেতের সাহায্যে চলে। সেই মেয়ে একদিন বড় হবে। সে তখন আরও দূরবর্তী গ্যালাক্সিদের ভেতরের খবর জানবে, জানাবে। বিশ্ববাসী তাঁর নাম জানবে। জানবে, মা তাঁকে গ্রহের গল্প শুনিয়েছিলেন একদিন, সেই থেকে সে বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী হয়ে যাবে, দূরদেশে যাবে অ্যাস্ট্রোনমি পড়তে।
তনিমা তাসনিম
তরুণ িবজ্ঞানী
জন্ম
২৬ জানুয়ারি ১৯৯১, ঢাকা
পেশা
গবেষক, ডার্টমাউথ কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র
প্রিয় বিজ্ঞানী
এমি নোয়েদার, রিচার্ড ফাইনম্যান
সিসিলিয়া পাইন-গেপোশকিন
অর্জন
সায়েন্স নিউজ-এর চোখে ২০২০
সালের ১০ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন হিসেবে মনোনয়ন, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রোমলি ফেলোশিপ ও নাসা স্পেস টেলেস্কোপ ও সার্নে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজের সুযোগ
একটা স্পেস মিশন শুধু গবেষণাই করে না, কয়েক প্রজন্মে বিজ্ঞানশিক্ষাকে অনুপ্রাণিতও করে। ১৯৬০-এর দশকে যখন স্পুতনিক নভোযান পাঠানো হয়েছিল, তখন থেকেই আমরা স্পেস-মিশনের কার্যকারিতা দেখেছি। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান মহাকাশ বিষয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন স্পুতনিক থেকে। মানুষের তৈরি প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুতনিক এভাবে কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঠিক একই প্রক্রিয়া আমরা দেখি ওপরের মা-মেয়ের কথোপকথনে। এই আলাপটি হয়েছিল ড. তনিমা তাসনিম অনন্যা ও তাঁর মায়ের মধ্যে।
আমরা এখন তনিমা তাসনিমের গল্প শুনব। যে তনিমা কৃষ্ণগহ্বরের পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকেছেন । দেখিয়েছেন, কীভাবে কৃষ্ণগহ্বরগুলো বেড়ে ওঠে এবং পরিবেশে কী প্রভাব রাখে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্স নিউজ-এর চোখে তিনি বিশ্বের সেরা ১০ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন।
তনিমা তাসনিমের বয়স যখন মাত্র ৫, তখন মহাকাশের বিষয়-আশয় মায়ের গল্পকথার মাধ্যমে তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়ে। এরপর আরেকটু বড় হয়ে তিনি মহাকাশ নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, ‘আস্তে আস্তে বুঝলাম, পৃথিবীর বাইরেও অনেক বড় একটা জগৎ আছে। আমাদের অস্তিত্ব সেখানে খুব ছোট। তখন থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলাম আমি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব।’
তনিমা পড়ালেখা করেছেন মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজে। সেই কলেজের গ্রন্থাগারে তাঁর আনাগোনা বেশি ছিল। স্কুলের আইজিসিএসই সিলেবাসের বাইরেও অন্য বইয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি জানিয়েছেন, ‘মানারাতে একটা চমৎকার কম্পিউটার ল্যাব ছিল, সেখানে আমি মনের মতো কোডিং (প্রোগ্রামিং সংকেত লেখা) করতে পারতাম। লাইব্রেরিতে প্রচুর বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ছিল, সেসব বই পড়তাম। এভাবেই ধীরে ধীরে আগ্রহ বেড়েছে। পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, কোডিং—এসবের প্রতি ভালো লাগা তো আছেই, সমস্যা সমাধানের প্রতি আমার সব সময় ঝোঁকও ছিল। দেখা গেল কোনো একটা কারণে মানসিক চাপে আছি, আমি অঙ্ক করতে বসে যেতাম। গান শুনতে শুনতে কোডিং করতাম। একটা কিছু বোঝার মধ্যে আনন্দ আছে। হয়তো এটি আপনার পরবর্তী জীবনে কোনো কাজে আসবে না, তবু। রিচার্ড ফাইনম্যান নামে একজন পদার্থবিদ আছেন, তিনি ‘দ্য প্লেজার অব ফাইন্ডিং থিংস আউট’ বিষয়ে অনেক কিছু লিখেছেন, তাঁর কথাগুলোর কিছু ইউটিউব ভিডিও আছে। তিনি যেভাবে বিজ্ঞান চর্চা করার আনন্দ বর্ণনা করেছেন, আমার কাছে সেটা বাস্তবের কাছাকাছি মনে হয়।’
অর্থাৎ সিলেবাসের পাশাপাশি তিনি ফিজিকস এবং কোডিংয়ের প্রতি জোর দিয়েছিলেন। আর চোখে ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের জোরে এ-লেভেল শেষে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় ব্রিন মার কলেজে। বলা ভালো, ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পরীক্ষায় খুবই ভালো ফল করেছিলেন তনিমা। বাংলাদেশের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনের কৃতিত্ব ছিল তাঁর ঝুলিতে।
ব্রিন মার মেয়েদের কলেজ। তনিমার ক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের লিবারেল আর্টসের এই কলেজ বেছে নেওয়ার কারণ তাঁদের পারিবারিক সংকোচ—মেয়ে পড়তে যাবে আমেরিকায়, সেখানে তো ভোগ আর উন্মাদনারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, মেয়ে যেন পার্টি না করে মন দিয়ে পড়ে—এমন মনোভাব ছিল তাঁর বাবা-মায়ের। ব্রিন মারের অন্তর্গত হেভারফোর্ড কলেজে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ানো হতো। আগাগোড়া পড়ুয়া তনিমা এখানে নিজেকে মোটামুটি গুছিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, তাঁর মনের সঙ্গেও কোথায় যেন মিল ছিল কলেজটির। আর এই পরিবেশ তাঁকে তৈরি হতেও শিখিয়েছিল। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্লাসেই তিনি নাসা ও সার্নে গিয়েছিলেন স্বল্পকালীন গবেষণার কাজে। তনিমা সার্নে থাকতেই হিগস কণা আবিষ্কৃত হয়; এবং স্বয়ং পিটার হিগসকে দেখা ছিল তাঁর জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত।
এরপর ২০১৩ সালে ব্রিন মার কলেজ থেকে তনিমা ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ফিজিকস ও অ্যাস্ট্রোনমি—ডাবল মেজর নিয়ে। রেজাল্টও তাক লাগানো—সিজিপিএ-৩.৯ ম্যাগনা-কাম-লডি! ২০১৫-১৭-তে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার অব ফিলোসফি ও মাস্টার অব সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। শেষে ২০১৯-২০ সালে ইয়েল থেকেই লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল সক্রিয় গ্যালাক্টিক নিউক্লিয়াসদের চারপাশে ভর কীভাবে জমা হয় (অ্যাক্রেশন হিস্ট্রি), সেই বিষয়ে। বর্তমানে তনিমা তাসনিম পোস্টডক্টরাল গবেষণা করছেন ডার্টমাউথ কলেজে রায়ান হিকক্সের গ্রুপে ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস বিভাগে।
পিএইচডিতে তনিমার লক্ষ্য ছিল দানবীয় ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণবিবর নিয়ে গবেষণা করা। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল বা দানবীয় কৃষ্ণবিবর একটা মোটামুটি জানা বিষয়। প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা দানবীয় কৃষ্ণবিবর থাকে—আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথেও আছে। এদের ভর সূর্যের কয়েক লাখ-কোটি গুণ! এই দানবদের চারপাশে থাকে অ্যাক্রেশন ডিস্ক, যা আসলে পদার্থ আর গ্যাসের এক ঘুরন্ত চাকতি। শনির বলয়ের মতো এই চাকতি ঘুরতে থাকে তার কেন্দ্রীয় কৃষ্ণবিবরের চারপাশে। কৃষ্ণবিবর যা কিছু টেনে নেয়, তার সবই জমা হয় চাকতিতে। পদার্থ ও গ্যাসের দ্রুত ঘূর্ণনের ফলে এখানকার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। সব সময় এখানে নানান সংঘর্ষ চলে। ফলে এগুলো এক্স-রশ্মির উৎসও বটে। দূর থেকে গ্যালাক্সির কেন্দ্রভাগে জোরালো এক্স-রে নির্গত হতে দেখা যায়, যার একটি উৎস হলো এই অ্যাক্রেশন ডিস্ক। এই ডিস্কের ভেতরে কী চলছে, তা দেখা যায় না। কেননা এটা আয়নিত গ্যাস আর পদার্থের এক সংগ্রহ, যা ঠিক দৃশ্যমান আলোয় খুব একটা বিকিরণ করে না। ফলে এই সংগ্রহের ভেতরকার খবর পেতে হলে ইনফ্রারেড আর এক্স-রে বিকিরণই ভরসা।
তনিমা আর তাঁর দলের কাজ ছিল নির্গত এক্স-রে বিকিরণ শনাক্ত করা। চারটি এক্স-রে টেলিস্কোপের ডেটা-সেট সংগ্রহ করে তিনি দেখলেন, দানবীয় ব্ল্যাকহোলটির বিবর্তন সম্পর্কে কিছু জানা যায় কি না। কিন্তু দেখা গেল, যেসব চলতি মডেল আছে সেগুলো হয় একটি ডেটা-সেটকে ব্যাখ্যা করে না হয় দু-একটি আংশিক ডেটা-সেটকে ব্যাখ্যা করে, পুরোটার নয়। তখন তনিমারা ভাবতে বসলেন, আরও ভালো কিছু করা যায় কি?
তনিমা সে সময় তাঁর শৈশবের কোডিং প্র্যাকটিসের ধাতটা কাজে লাগালেন। শিখে নিলেন নিউরাল নেটওয়ার্ক, যা এক রকমের মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম। এই কমপিউটেশন পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ব্যাখ্যা করলেন, অ্যাক্রেশন ডিস্কের এক্স-রে বিকিরণ কী বার্তা বহন করছে।
তনিমার পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে দানবীয় কৃষ্ণবিবরের অনেক লুকানো রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ফলে তাঁর হাতে এমন এক সাধারণীকৃত এক্স-এল-এফ (এক্স-রে লুমিনোসিটি ফাংশন) উন্মোচিত হলো, যা দিয়ে সব সক্রিয় গ্যালাকটিক নিউক্লিয়াসের (অ্যাকটিভ গ্যালাকটিক নিউক্লেউ, এজিএন) এক্স-রে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি লুকানো দানবীয় কৃষ্ণবিবর সময়ের সঙ্গে কীভাবে বিকশিত হয়, তার হদিস মেলে। তনিমার কথায়, ‘কৃষ্ণগহ্বরের মৌলিক উপাদান তিনটি—চার্জ, ভর আর ঘূর্ণন। অর্থাৎ এটা কত দ্রুত ঘুরছে। আমি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর মডেলটা তৈরি করেছি, তার মাধ্যমে এই মৌলিক উপাদানগুলো পরিমাপ করতে সুবিধা হবে, সেই সঙ্গে এটা ছায়াপথের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা-ও আমরা জানতে পারব। এটা কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃত চিত্র নয়। কিন্তু অনেকগুলো কৃষ্ণগহ্বরের উপাত্ত থেকে পাওয়া একটি পরিসংখ্যানগত চিত্র।’
কৃষ্ণবিবর–শিকারি তনিমা তাসনিম আমাদের গর্ব। তাঁর গবেষণা ‘সায়েন্স নিউজ: টেন সায়েন্টিস্টস টু ওয়াচ ২০২০’-এ উল্লিখিত হয়েছে, তখন তাঁর বয়স ত্রিশ পেরোয়নি। আজ সারা বিশ্ব জানে বাংলাদেশের মেয়ে তনিমা কীভাবে দুনিয়ার মহাকাশবিজ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠ কাতারে ঠাঁই পেয়েছেন। ‘উই-স্টেম’ নামে একটি সংগঠন করেছেন তিনি। কয়েকজন প্রবাসী মার্কিন বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের মেয়েদের সায়েন্স-মেন্টরশিপ প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে এসে তাদের পথনির্দেশনা দিচ্ছেন।
তনিমা তাসনিমের ভক্তরা জেনে খুশি হবেন, তাঁর প্রিয় ব্ল্যাকহোল সিগনাস এক্স-ওয়ান। সেটি কী তা জানতে স্টিফেন হকিংয়ের ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম ও কিপ থর্নের ব্ল্যাক হোল অ্যান্ড টাইম ওয়ার্প্স বই দুটো এই ফাঁকে পড়ে নিতে পারেন এবং জেনে নিতে পারেন স্টিফেন হকিং আর কিপ থর্নের বিখ্যাত বাজি রাখার গল্প। বাজিতে হারলে বিজেতা কী পাবেন, সেটাও উত্তেজক এক খবর। কে জানে, আপনিই হয়তো তনিমার মতো মহাকাশের তন্বিষ্ঠ গবেষক হয়ে উঠবেন!
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎকৌশল বিভাগের অধ্যাপক