কৃষিতে নারী

কৃষিতে যেভাবে নারীর সংখ্যা শতক থেকে কোটিতে

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ভূমির মালিকানায় খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে, মজুরির ক্ষেত্রেও আছে চরম বৈষম্য

বিলকিস বেগমের (৩৮) নিজের মালিকানায় পাঁচ শতক জমি আছে, স্বামীর আড়াই বিঘা। বছরজুড়েই জমিতে শস্য ফলান। গত চার মাসে আমন ধানের পর আলু আর ইরি ধান বিক্রি করেছেন ১ লাখ ২৬ হাজার টাকার। স্বামী স্থানীয় একটি বেসরকারি সংগঠনের কাজে যুক্ত। তাই কৃষিকাজ দেখভালের বেশির ভাগটাই নিজে করেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইউনিয়নের নাটমরিচাই গ্রামের বিলকিস বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামে চাকরিজীবী, কৃষক, সংসারী সব মানুষই আছে। আমার মতো মধ্যবিত্ত নারীদের সবাই কৃষিকাজ দেখে।’

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বৃহত্তর কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। গত ৪৭ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা শতকের ঘর থেকে কোটিতে পৌঁছে গেছে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫০ বছরে নারীর অংশগ্রহণের সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও ধারাবাহিকভাবে সংকলিত নেই। বেশির ভাগ গবেষণায় নব্বইয়ের দশকের পর থেকে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, দেশে শ্রমশক্তি জরিপ পরিচালনা হচ্ছে ১৯৮৩ সাল থেকে। এরপর থেকে বিভিন্ন বছরের জরিপে নারী কৃষকের তথ্য আছে। এর আগের তথ্যের ক্ষেত্রে একমাত্র সূত্র জাতীয় জনসংখ্যা জরিপ।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আর্কাইভ থেকে ১৯৬১, ১৯৭৪ ও ১৯৮১ সালের জাতীয় জনসংখ্যা জরিপ এবং ১৯৮৩ সালের পর থেকে শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখে গেছে, বৃহত্তর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে কৃষিতে পুরুষের সংখ্যা তুলনামূলক কমছে, আর নারীর সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবশেষ ১৯৬১ সালের জরিপ অনুসারে, কৃষিতে নারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৩। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসংখ্যা জরিপ ১৯৭৪ অনুসারে, ওই সময় দেশে অর্থনৈতিক কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন ১৫ হাজার ৮২৩ জন। এর মধ্যে নারী ৬১০ জন। সে সময়ে মোট নারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪৪ লাখ।

২০১৮ সালে প্রকাশিত সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে, কৃষিতে এখন নারীর অংশগ্রহণের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জরিপের বছরে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ১৩ লাখ। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩ লাখ।

কৃষি অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, কৃষিকাজ বলতে এখন বোঝানো হয় শস্য উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ ও বনায়ন বা বাড়ির আশপাশে গাছ লাগানো ইত্যাদি। গ্রামে কৃষির প্রাধান্য বেশি। মূলত পুরুষেরা শহরে পড়াশোনা, চাকরি ও ব্যবসার দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়ায় কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহর মতে, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপেই কৃষিতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এখন সরকারের বাণিজ্যিক কৃষি কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলোতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী থাকা বাধ্যতামূলক। প্রশিক্ষণ পেয়ে নারীরা কৃষিতে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বসতবাড়ির আঙিনায় ও আশপাশে ফল উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালনে উৎসাহিত করার কারণেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।

৩২ বছর আগে কৃষিতে যুক্ত হন কল্পনা দাশ

বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের বেতাগা গ্রামের কল্পনা দাশ (৬০) তিন দশকের বেশি সময় ধরে খামার চালাচ্ছেন। প্রথম আলোকে জানালেন, ৩১ শতক জমির ওপর বসতবাড়ি লাগোয়া দুটি খামারের মোট আয়তন ১৪ শতক। গড়ে দেড় হাজারের মতো মুরগি থাকে। হাঁস-মুরগির ডিম, মুরগি আর গরুর দুধ বিক্রি করে মাসে গড়ে ৩৫ হাজার টাকা আয় করেন। কল্পনা দাশ বললেন, এ কাজে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো হুটহাট লোকসানে পড়ার ঝুঁকি। করোনাকালে লোকসান কাটাতে পুরোনো সব মুরগি বিক্রি করে নতুন বাচ্চা মুরগি কিনতে যাচ্ছেন।

বগুড়ার নাটমরিচাই গ্রামের খোরশেদা বেগমের (৩৫) বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর আগে। স্বামী মামুনুর রশিদ একটি বিমা কোম্পানিতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। খোরশেদা প্রথম আলোকে বলেন, বিয়ের পর থেকেই তিনি এ বাড়ির কৃষিকাজ দেখভাল শুরু করেন। ছয় বিঘা জমিতে পালা করে ধান আর আলু লাগান। ১০৭ মণ আমন ধান ও ৫০০ মণ আলু বিক্রির পর এখন নতুন করে ইরি ধান লাগানো হয়েছে। তবে নিজের উপার্জন হয় গরুর খামার থেকে। আগে হাঁস-মুরগিও ছিল। এখন তিনটি গরু আছে। দিনে ২-৩ লিটার দুধ পান। প্রতি লিটার ৪০ টাকা দাম পান। টাকাটা খরচ হয় সংসারের কাজেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলায় মা থেকে শুরু করে বাসার মেয়েদের কৃষিকাজ করতে দেখেছি। এ কাজে আমাদের অভ্যাস আছে।’ স্বামী মামুনুর রশিদ জানালেন, তিনি চাকরি করেন বলে তাঁর পরিবারের কৃষিকাজ, খামার সব কাজের সঙ্গেই স্ত্রী যুক্ত থাকেন। তাঁর দাদি গুলজান বেওয়া ও মা আয়েশা বেগমও জীবদ্দশায় পরিবারের কৃষিকাজ তদারকি করেছেন।

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ইসমত আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, পড়াশোনা, চাকরি ও কৃষিকাজকে সম্মানজনক পেশা মনে না করায় অনেক পুরুষ শহরে চলে যাচ্ছে বা কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছে। নারীরা এখন সে জায়গাটি পূরণ করছে। আগে কৃষিতে নারীর কাজগুলো ছিল অদৃশ্যমান। এখন তা দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি সংগঠনগুলো গ্রামে নারীদের ওপর আলোকপাত করে কাজ শুরুর পর কৃষিতে নারীর কাজের স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে আসে। এখন সরকারও বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রশিক্ষণে নারীদের সম্পৃক্ত করছে।

কোন সময়ে কত নারী

জাতীয় জনসংখ্যা এবং শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, কর্মজীবী নারী ও পুরুষের নিজ নিজ ক্ষেত্র অনুসারে ১৯৭৪ সালে ৭০ শতাংশ নারী (ওই সময় খুব অল্পসংখ্যক কর্মজীবী নারীর বেশির ভাগ কৃষিতে ছিলেন) ও ৭৭ শতাংশ পুরুষ, ১৯৮১ সালে ২৭ শতাংশ নারী ও ৬১ শতাংশ পুরুষ, ১৯৯৯-২০০০ সালে ৪৮ শতাংশ নারী ও ৫০ শতাংশ পুরুষ, ২০১০ সালে ৬৫ শতাংশ নারী ও ৪০ শতাংশ পুরুষ কৃষিতে যুক্ত ছিলেন। সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে, ২ কোটি ৪৭ লাখ বা ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষিতে যুক্ত (১৫ ও এর চেয়ে বেশি বয়সী)। এর মধ্যে নারী ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং পুরুষ ২২ দশমিক ৩ শতাংশ।

পুরুষদের মধ্যে যতসংখ্যক পুরুষ কৃষিকাজে যুক্ত, তার চেয়ে নারী কর্মজীবীদের মধ্যে অনেক বেশিসংখ্যক নারী কৃষিকাজে যুক্ত। কর্মজীবী নারীদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৩২ দশমিক ২ শতাংশ কৃষিতে যুক্ত।

মজুরি ও ভূমির মালিকানায় পেছনে

অধ্যাপক ইসমত আরা বেগম গত বছরের ডিসেম্বরে ‘পুটিং উইমেন ইন দ্য সেন্টার অব অ্যাগ্রিকালচার’ শিরোনামে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা তাঁর এক গবেষণাপত্রে দেখান, গত ২৫ বছরে গ্রামে শ্রমে অংশ নেওয়ার হার পুরুষের তুলনায় নারী ১০ শতাংশ বেড়েছে। তবে মাত্র ১৫ শতাংশের কাছাকাছি নারী মজুরিযুক্ত কাজে জড়িত। আবার মজুরিযুক্ত কাজে জড়িত নারীরা শিকার হচ্ছেন মজুরিবৈষম্যের। একজন পুরুষ শ্রমিক ২৮৫ থেকে ৩৫২ টাকা করে পান। একই কাজের জন্য নারীরা পান ১৮২ থেকে ২১৪ টাকা। এ ছাড়া নারীরা মূলত কাজ করেন পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে। জীবিকার প্রয়োজনে অনেক নারী এখন বাজারে আসেন। তবে তাঁদের বিক্রয় করা পণ্যের অর্থ স্বামী নিয়ে নেন। ফলে এ কাজে নারীর যে শ্রম ও সময় ব্যয় হয়, তা অবমূল্যায়িত থেকে যায়।

তবে কৃষক বিলকিস বেগম যা তথ্য দিলেন তাতে মজুরিবৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোর থেকে দুপুরের খাবারের সময়ের আগ পর্যন্ত তিনি পুরুষ কৃষিশ্রমিককে ৭০০ টাকা ও নারী শ্রমিককে ২০০ টাকা দেন। নারীদের এত কম দেন কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এটাই এখানে নিয়ম। পুরুষেরা কাজ বেশি করে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন্দ নিলোর্মি ‘গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারী: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’ শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদনে ভূমির মালিকানার ওপর ২০ বছরের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জানান, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ভূমির মালিকানায় খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ৯৮ শতাংশ পুরুষ ও ২ শতাংশ নারীর ভূমির ওপর মালিকানা ছিল। আর ২০১৩ সালে ভূমির ওপর পুরুষের মালিকানা ৯৬ দশমিক ৫২ এবং নারীদের ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সিদ্ধান্ত ও উপার্জনে পুরুষনির্ভরতা

শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে কৃষিতে সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৬, চাকরিতে ৩৯ এবং শিল্পে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ যুক্ত রয়েছে। তবে পুরুষের তুলনায় কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৪ শতাংশ কম হলেও কৃষিপণ্য উৎপাদন ও উপার্জনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরতা অনেক বেশি।

‘পুটিং উইমেন ইন দ্য সেন্টার অব অ্যাগ্রিকালচার’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ও আয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এক-তৃতীয়াংশ নারী সুযোগ পান। খাদ্যশস্য উৎপাদনে ৩৫ শতাংশ, বিক্রির জন্য উৎপাদিত শস্যের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৩ শতাংশ, মাছ চাষের ক্ষেত্রেও প্রায় ৩৩ শতাংশ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর আয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে দেখা যায় হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল পালনে। এ ক্ষেত্রে এক-পঞ্চমাংশ নারী উৎপাদন থেকে শুরু করে উপার্জনের প্রতিটি ধাপে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেন। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এটা একটি ভালো দৃষ্টান্ত।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে জানান, কৃষিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মজীবী মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। নারী কর্মজীবীদের মধ্যে কৃষিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী যুক্ত থাকায় অর্থনীতিতে নারী কৃষকদের ভূমিকা ব্যাপক। তিনি আরও বলেন, কৃষক, খামারি বা মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে চিন্তা করলে নারীর কথা কেউ চিন্তা করেন না। ভূমির মালিকানা না থাকায় সরকারি সুবিধাদি, কৃষি কার্ড, ভর্তুকি, ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা পান না নারী। ব্যক্তি উদ্যোগে ফসলের জন্য জমি লিজ ও বর্গা নেওয়ার ক্ষেত্রে চুক্তি হয় পুরুষের সঙ্গে। ফলে এক পরিবারের দুজনে মিলে কাজ করলেও পুরুষ নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই কৃষি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন নারী। বিপণনব্যবস্থায় নারীকে সম্পৃক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর ওপর জোর দেন তিনি।