কৃষিতে আলোর পথের দুই যাত্রী

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় দুই তরুণের খামারে গাছে ড্রাগন ফল। ছবি: প্রথম আলো
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় দুই তরুণের খামারে গাছে ড্রাগন ফল।  ছবি: প্রথম আলো

নিজেদের সবুজ কৃষি মাঠগুলো শিল্পাঞ্চলের আধুনিকতায় প্রায় ঢেকে যাচ্ছিল। কৃষির সঙ্গে মিশে থাকা শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে হারাতে চাননি তাঁরা। ভাগ্যকে মাটির মায়ায় জড়িয়ে শ্রম ও মেধার জোরে করলেন কৃষিখামার। দেশি–বিদেশি ফলের আবাদ করলেন। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাফল্যও পেলেন।

গাজীপুরের শ্রীপুরে ফলের বাগানের দুই তরুণ উদ্যোক্তা হলেন আতাউর রহমান (৩০) ও আলাল উদ্দিন (২৮)। তাঁরা এলাকায় আধুনিক কৃষির আইকন বনে গেছেন। পূর্বপুরুষদের কৃষিতে আত্মনিয়োগ করতে দেখেছেন তাঁরা ছোট বয়স থেকেই। কিন্তু বয়স বাড়তে থাকলে তাঁরা লক্ষ করেন, শিল্পায়নের কারণে ক্রমশ শ্রীপুরের প্রায় সব অঞ্চলের মানুষ কৃষি থেকে সরে আসছে। এমন বিমুখতার কারণ খুঁজতে থাকেন তাঁরা। কারণ হিসেবে কৃষি উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত মুনাফা করতে না পারাকে চিহ্নিত করেন তাঁরা। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। কৃষিতে প্রচলিত ফসলের বিকল্প কিছু করা যায় কি না, তা নিয়ে কাজ শুরু করেন। সালটা ২০১৩। আতাউর ডিগ্রি পাস করে কৃষিতে ঝুঁকে পড়েন। সঙ্গে নেন ভাগনে আলাল উদ্দিনকে। আলাল তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। উপজেলার গোদারচালা গ্রামে নিজেদের বাড়ির পাশে ও বাড়ির কাছে মুলাইদ গ্রামে মোট ৮ একর জমিতে গড়ে তোলেন কৃষিখামার। এটি প্রচলিত খামার থেকে ভিন্ন। এখানে ড্রাগন ফল, বারি জাতের মাল্টা, লেমন গ্রাস, স্ট্রবেরি, পেয়ারা, তাইওয়ানের তরমুজ, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করেন। তাঁদের খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে ১২ জন যুবকের।
গত বুধবার দুপুরে দুই তরুণের খামার ঘুরে দেখা যায়, একেকটি মাল্টাগাছে প্রচুর ফল ঝুলে আছে। কর্মীরা গাছগুলোর পরিচর্যা করছেন। ড্রাগন ফলগুলো এখনো সবুজ। কিছুদিনের মধ্যেই তা পেকে যাবে বলে জানান কর্মীরা। একেকটি মাল্টার গড় ওজন ২০০ গ্রাম হয় বলে জানান আতাউর। এক কেজি মাল্টা পাইকারিতে ১২০-১৫০ টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা। ড্রাগন ফলের গাছের প্রতিটির মাথায় গাড়ির ছোট ছোট টায়ার দেওয়া। গাছের কাণ্ডগুলো সিমেন্টের খুঁটি বেয়ে টায়ারে ঝুলে আছে। প্রতিটি গাছেই কাঁচা সবুজ ড্রাগন ফল ঝুলছে।
আলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালেই কৃষিতে যুক্ত হন তাঁরা। ছোটবেলাতেই পারিবারিক কৃষিতে তাঁদের হাতেখড়ি। কিন্তু কৃষি থেকে যখন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন লাভজনক কৃষিপণ্য হিসেবে বিদেশি ফল ও ফসল চাষের চিন্তা করেন তাঁরা। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের আয় করার এই অভিপ্রায়ে সায় দেয় দুজনের পরিবার। ধারদেনা করে শুরু করেন স্বপ্ন বোনার কাজ।
আতাউর রহমান প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান, ২০১৩ সালে রাজশাহী থেকে আট হাজার স্ট্রবেরির চারা এনে বোনেন তাঁরা। এরপর ওই বছরই ৮ লাখ টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করেন। এতে তাঁদের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। নাটোর থেকে থাই জাতের পেয়ারা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এরপর ২০১৪ সালে খামারে যোগ করেন বিদেশি ড্রাগন ফল। এই ফলও খুব ভালো বিক্রি হয়। পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে চার একর জমিতে বারি মাল্টার চাষ শুরু করেন। একই সঙ্গে লেমন গ্রাস (লেবুর স্বাদযুক্ত ঘাস, খাবারে ব্যবহৃত হয়) ও ব্রোকলি চাষ শুরু করেন। তিনি জানান, মাল্টার ১০ হাজার চারা তৈরি করে তা সুলভ মূল্যে বিক্রির জন্য রাখা আছে। এগুলো যেকোনো উদ্যোক্তার কাছে বিক্রি করে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে চান তাঁরা। 
আতাউর আরও বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে এই খামার আরও বড় করতে চান তাঁরা।
এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মূয়ীদ উল হাসান জানান, গাজীপুরে দেশি-বিদেশি ফল ও ফসলের এটিই সবচেয়ে বড় খামার। দুই তরুণ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন কৃষির মাধ্যমে—এটি খুবই উৎসাহজনক। বেকার যুবকেরা এমন খামার গড়ে কৃষিকে সমৃদ্ধ করলে দেশ উপকৃত হবে, বেকারত্বও ঘুচবে।