উৎপাদনের চেয়ে সরকারিভাবে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা অনেক কম। এ কারণে অনেক স্থানে লটারির মাধ্যমে ধান কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অথচ লটারির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রির সুযোগ পেয়েও ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রির স্লিপ বিক্রি করে দিয়েছেন কৃষকেরা।
এ ছাড়া লটারিতে অংশ নেওয়ার জন্য কৃষকদের যে কৃষিকার্ড তৈরি করা হয়েছে, সেটিও ত্রুটিপূর্ণ। নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি নেই এমন কৃষকের কৃষিকার্ড করা হয়েছে। মারা গেছেন এমন কৃষকও লটারিতে বিজয়ী হয়েছেন। এই অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায়। লটারিতে নির্বাচিত হওয়া বেশির ভাগ কৃষক তাঁদের ধান বিক্রির স্লিপ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা অভ্যন্তরীণ ধান ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি ও আদমদীঘি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ বিন রশিদ বলেন, বিষয়টি খুব জটিল। কৃষকেরা যদি তাঁদের স্লিপ বিক্রি করে দেন, তাহলে তা বের করা খুব কঠিন। বিষয়টি নজরদারিতে রয়েছে। এ রকম কাউকে শনাক্ত করা গেলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা শাহানশাহ হোসেন দাবি করেন, যাঁরা প্রকৃত কৃষক, শুধু তাঁদের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে আদমদীঘি উপজেলায় সরকারিভাবে ৩৬৩ মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়। স্বল্প পরিমাণ ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ায় জটিলতায় পড়ে উপজেলা ধান ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি। পরে লটারির মাধ্যমে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয় উপজেলা অভ্যন্তরীণ ধান ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি।
আদমদীঘি উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আদমদীঘি উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকায় কৃষিকার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা ২৭ হাজার। তাঁদের মধ্যে এক থেকে দুই একর জমি আছে—এমন প্রায় পাঁচ হাজার কৃষককে লটারিতে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত করা হয়। গত ২৭ মে লটারির মাধ্যমে ৩৬৩ জন কৃষককে নির্বাচিত করে প্রত্যেক কৃষককে এক মেট্রিক টন ধান সরকারি গুদামে বিক্রির স্লিপ দেওয়া হয়। ধান কেনা চলবে আগস্ট মাস পর্যন্ত।
১২ জুন উপজেলার দমদমা গ্রামে গিয়ে লটারি বিজয়ী নুরুল ইসলাম, বেলাল হোসেন, ফজলুল হক ও হারুনুর রশিদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, গুদামের নানা ঝামেলা এড়াতে ধান বিক্রির প্রতিটি স্লিপ তাঁরা আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। উপজেলার করজবাড়ি, কদমা, ডহরপুর, ডুমরিগ্রাম, কড়ই, পুসিন্দা’সহ একাধিক গ্রামে গিয়ে স্লিপ বিক্রির বিষয়টি জানা গেছে।
বর্তমানে স্থানীয় হাটবাজারে প্রতি মণ চিকন জাতের জিরাশাইল (মিনিকেট), বিআর-২৯ ও কাটারিভোগ ধান ৭০০ এবং মোটা জাতের হাইব্রিড জাতের ধান ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারিভাবে মোটা ধান প্রতিমণ ১০৪০ টাকা দরে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাজারমূল্যের চেয়ে সরকারিভাবে ধানের ক্রয়মূল্যের ব্যবধান প্রায় ৫০০ টাকা। ধানের ক্রয়মূল্যের এই পার্থক্যের কারণে ফড়িয়ারা কৃষকদের কাছ থেকে ধান বিক্রির স্লিপ কিনতে মরিয়া হয়ে পড়েছে।
>নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি নেই এমন কৃষকের জন্য কৃষিকার্ড তৈরি করা হয়েছে।
কৃষকেরা ২০০০-২৫০০ টাকায় ধান বিক্রির স্লিপ বিক্রি করে দিচ্ছেন।
কৃষিকার্ড তৈরির ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেসব কৃষকের নির্ধারিত পরিমাণ জমি নেই, তাঁদের নাম সবচেয়ে বেশি লটারিতে পাওয়া গেছে। সান্তাহার ইউনিয়নের কায়েতপাড়া গ্রামের কৃষক তছলিম উদ্দীন, ইব্রাহিম প্রামাণিক; দমদমা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, মুক্তার হোসেন, হারুনুর রশিদ, বেলাল হোসেন; কাশিমিলা গ্রামের উজ্জল খান; ছাতনী গ্রামের সুভাষ দেবনাথের নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি নেই। কিন্তু তাঁদের নাম লটারিতে এসেছে। এ বিষয়ে তাঁরা বলেন, তাঁদের কারও এক একরের বেশি জমি নেই। কিন্তু কীভাবে লটারিতে নাম উঠেছে, তা তাঁরা জানেন না।
দমদমা গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম মারা গেছেন প্রায় দুই বছর আগে। তিনিও লটারিতে বিজয়ী হয়ে ধান বিক্রির সুযোগ পেয়েছেন। অথচ নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি থাকার পরেও কায়েতপাড়া গ্রামের কৃষক শফির উদ্দীন, দমদমা গ্রামের গোলাম আম্বিয়া, কাশিমিলা গ্রামের বাচ্চু প্রামাণিক, করজবাড়ি গ্রামের ইয়াকুব আলী লটারিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি। এ বিষয়ে তাঁরা বলেন, তাঁদের প্রত্যেকের এক একরের বেশি জমি থাকার পরও লটারিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকেরা তাঁদের ধান সরকারি গুদামে বিক্রি করছেন কি না, তা তদারকির ব্যাপারে কৃষি বিভাগের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষিকার্ড তৈরির দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা।
কৃষক গোলাম আম্বিয়া বলেন, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় কৃষিকার্ড তৈরিতে কৃষকদের প্রকৃত তথ্য উঠে আসেনি। এ ক্ষেত্রে যাঁরা কৃষক নন, তাঁরা কৃষক হয়ে গেছেন, আবার যাঁরা প্রকৃত কৃষক, তাঁদের জমির আসল তথ্যে কার্ডে উঠে আসেনি।
এ বিষয়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামসুল কুদ্দুস জানান, কৃষিকার্ড তৈরির সময় সরকারিভাবে কৃষকদের জমির দলিলপত্র দেখে কার্ড তৈরির কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এ কারণে কৃষকেরা যে তথ্য দিয়েছেন, সে অনুযায়ী কার্ড তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিঠু চন্দ্র অধিকারী বলেন, কৃষকেরা কার্ড তৈরির সময় সঠিক তথ্য না দেওয়ায় কৃষিকার্ডে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পাওয়া গেছে। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে মারা যাওয়া কৃষক নুরুল ইসলামের জন্য কৃষিকার্ড তৈরি করা হয়েছিল। শিগগিরই এটি সংশোধন করা হবে।