কৃষকের স্বপ্ন বিক্রি হচ্ছে দুই টাকা কেজিতে

করোনার প্রভাবে সবজির দাম না পাওয়ায় সর্বস্বান্ত ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার সবজিচাষিরা। ছবি: লেখক
করোনার প্রভাবে সবজির দাম না পাওয়ায় সর্বস্বান্ত ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার সবজিচাষিরা। ছবি: লেখক

রুনা আক্তারের বাড়ি গাজীপুরে। বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়ের গোপীনাথপুর গ্রামের কৃষক হোসেন মিয়ার সঙ্গে। একসময় দুজনই পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সেই চাকরি ছেড়ে এই দম্পতি ফিরে আসেন মাটির টানে গ্রামে। সংসারের অসচ্ছলতা ঘোচাতে এক সন্তানের জননী রুনা সঞ্চিত ৩০ হাজার টাকা আর এনজিওর ঋণ নিয়ে দুই কাঠা জমি বন্ধক নেন। 

জমিতে চাষ করেন উচ্চফলনশীল জাতের করলা। মাচা তৈরি, চারা রোপণ, পরিচর্যা থেকে শুরু করে ফলন আসার আগ পর্যন্ত তাঁর হয় প্রায় ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাবে এবার বিক্রি মৌসুমের শেষে দাঁড়ায় মাত্র ৫০০ টাকায়। সর্বশেষ ৮০ টাকা মণে করলা বিক্রি করেছেন রুনা। সঞ্চয় এবং এনজিও থেকে ঋণের টাকায় সবজি উৎপাদন করে এখন চরম বিপাকে রুনা। তাঁর পরিবার সামনের মৌসুমে নতুন সবজি চাষ করবে কি না, তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

শুধু রুনা আক্তার নন, ফুলবাড়িয়া উপজেলার অনেক সবজিচাষির এ অবস্থা। করোনার প্রভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকার না আসায় এবং পরিবহন বন্ধ থাকায় সবজির ন্যায্যমূল্য তাঁরা পাননি। সবজি বিক্রি করতে না পারায় সবজি নষ্ট হচ্ছে এখন খেতেই। তাই সর্বস্বান্ত রুনার মতো এমন কৃষকের স্বপ্নের ফসল এখন হাটে বিক্রি হচ্ছে দুই টাকা কেজি দরে।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার প্রায় সব সবজিচাষি এখন সর্বস্বান্ত। এদিকে এবারের মৌসুমে ঘাটতি থাকায় সামনের মৌসুমের সবজি উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে জানান চাষিরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সবজি চাষাবাদ থেকে চাষিরা মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি পুষ্টির অভাব দেখা দেবে। এই সমস্যা দূর করতে সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের নামের তালিকা করে তাঁদের প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে সবজি চাষে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

রুনা তাঁর সঞ্চিত অর্থে করলা আবাদ করে এখন সর্বস্বান্ত। ছবি: লেখক

সবজিচাষিদের এমন ভয়াবহ সংকটকালে কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি সবজিচাষিদের সবজি বিক্রি এবং তাঁদের ঘাটতি নিরসনে কোনো প্রকার তদারকি করছেন না বলে অভিযোগ কৃষকদের। যদিও প্রতিটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মাঠপর্যায়ে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্লক সুপারভাইজার ফসলের মাঠে কৃষকের ফসলের খোঁজ নিতে আসার কথা থাকলেও কালেভদ্রেও তাঁদের দেখা মেলে না বলে অভিযোগ কৃষকদের।


সরেজমিনে উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুর, এনায়েতপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর, ফুলতলা, বাক্তা ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর, শ্রীপুর, কালাদহ ইউনিয়ন এবং পুটিজানা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, মৌসুমি সবজি যেমন কলা, বেগুন, টমেটো, শসা, লাউ–কুমড়া, লেবুসহ নানা সবজি নষ্ট হচ্ছে খেতে। বিভিন্ন স্থানীয় বাজারগুলোতে লকডাউন থাকায় কৃষক তাঁর পণ্য নিতে পারছে না, পাশাপাশি বাজারে পাইকার না থাকায় ন্যায্য দামও পাচ্ছেন না চাষিরা। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ করে সবজি চাষ করে বিক্রি করতে না পারায় চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা।

উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া এবং এনায়েতপুর ইউনিয়নে অন্তত ১ হাজার ৫০ একর জমিতে সবজির চাষা হয়েছে; যা বিক্রি না হওয়ায় এবং বাজারমূল্য না থাকায় কোটি টাকার বেশি লোকসানের মুখে পড়েছেন সবজিচাষিরা।

উপজেলার বাবুগঞ্জ বাজারে সবজি বিক্রি করতে না পেরে এভাবেই করলা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সবজিচাষিরা। ছবি: লেখক

রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের সবজিচাষি রহিমা খাতুন, সেলিম হোসেন, মাহমুদ আলী এবং এনায়েতপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের কাজিম উদ্দিন, মোস্তাক মিয়া, জয়নাল, হায়দার আলী বলেন, রাঙ্গামাটিয়া আর পাহাড় অনন্তপুর এবং এনায়েতপুরের গোপীনাথপুর ও ফুলতলায় উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদন হয়। এখানকার সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা কিনে নিয়ে যান। এবার করোনাভাইরাসের কারণে এবং স্থানীয় কিছু পাইকারের সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন বলে অভিযোগ তাঁদের। তাঁরা বলেন, বাজারে নিলে করলা দুই টাকা কেজি, কলা ও বেগুন কেউ এক টাকা করেও কেনে না। কোনো সবজি বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। সব সবজি পচে যাচ্ছে খেতে। এদিকে মৌসুমও শেষ। তাই সামনের মৌসুমে নতুন সবজি চাষের টাকাও তাঁদের হাতে নেই। সরকার ঋণসহায়তা ও প্রণোদনা না দিলে সবজির আবাদ করা সম্ভব নয়।


ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলাটির মৌসুমি সবজি উৎপাদনের জন্য দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে। বিশেষ করে আলু, হলুদ, রসুন, কলা, শিম, বরবটি, করলা, বেগুন, লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজির চাষ হয় এ জনপদে। প্রতি সপ্তাহে উপজেলার কালাদহ, গোপীনাথপুর, বাবুগঞ্জ ও ফুলবাড়িয়ায় সবজির বড় হাট বসে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা আসেন সবজি কিনতে।

এখন করোনার প্রভাবে পাইকার না আসায় এবং বিভিন্ন জায়গায় লকডাউন থাকায় স্থানীয় পাইকারেরা সবজি কিনছেন না। এর মধ্যে আবার স্থানীয় পাইকারদের সিন্ডিকেট করার অভিযোগও করছেন কৃষকেরা।

এভাবেই কৃষকের খেতে নষ্ট হচ্ছে করলা। ছবি: লেখক

উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুরের সবজিচাষিদের ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী বলেন, রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের একটি বড় অংশের মানুষের সবজি চাষের ওপর তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করে। বিশেষ করে পাহাড় অনন্তপুরে প্রচুর মৌসুমি সবজির আবাদ হয়। এবার করোনার প্রভাবে চাষিরা খুবই বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। তাঁরা বাজারে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। সব প্রান্তিক সবজিচাষিকে সরকারিভাবে প্রণোদনার আওতায় আনা প্রয়োজন এবং সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা।


তবে উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নে লেবুর জন্য জনপ্রিয়। ফুলতলা গ্রামের লেবুচাষিরা শুরুত লেবুর দাম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও স্থানীয় কিছু সিন্ডিকেটের কারণে দাম ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে বলে জানান ফুলতলার লেবুচাষি নুরুল ইসলাম মাস্টার।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, এবার উপজেলায় ১ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে শুধু সবজি। এর মধ্যে করলা চাষ হয়েছে ২৬০ হেক্টর জমিতে। বাকি জমিতে শসা, লাউ, বেগুন, কুমড়াসহ অন্যান্য সবজির চাষ হয়েছে।

পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণে লেবুর দাম কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। ছবি: লেখক

এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া কৃষি কর্মকর্তা জেসমিন নাহার বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে আমরা সবজিচাষিদের ব্যাপারে গাইডলাইন পাইনি, তবে ক্ষতিগ্রস্ত সবজিচাষিদের অবস্থা খুবই খারাপ। সরকারের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। কেননা কৃষকেরা সবজি চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশে খাদ্যঘাটতিসহ পুষ্টিহীনতার একটা বড় সংকট দেখা দিতে পারে।’


জেসমিন নাহার আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে শুধু চাল, ডাল আলু ইত্যাদি দিতে দেখছি। বর্তমানে ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে যদি কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিতরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে কৃষকেরা অন্তত তাঁর পণ্যের ন্যায্য দাম পেতে পারেন।’


পৃথিবীতে হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশও। সবকিছু বন্ধ থাকায় পণ্যের দাম না পাওয়ায় গ্রামের প্রান্তিক চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছনে। দ্রুত সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত সবজিচাষিদের তালিকা করে তাঁদের প্রণোদনা এবং সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে সবজি চাষে আবারও উদ্বুদ্ধ করে তোলা দরকার।