দেখতে অনেকটা বাঙ্গির মতোই। তবে আছে কিছু পার্থক্য। বাঙ্গির মতো গায়ে শির রেখা নেই। গায়ের রং এবং গন্ধও আলাদা। স্বাদেও আছে কিছু পার্থক্য। বাঙ্গি রবি মৌসুমের ফল, পাকতে শুরু করে চৈত্র মাসে। আর লালমির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শীতের দুই মাস বাদে বছরের যেকোনো সময় চাষ করা যায়।
রোপণের ৬০ দিনের মধ্যে লালমি পেকে যায়। তাই জেলার কৃষকেরা পবিত্র রমজান মাসকে লক্ষ্য রেখে চাষ করেন। প্রথম রমজান থেকেই বাজারে প্রচুর লালমি উঠেছে। আর লালমি মূলত ফরিদপুরের কৃষকদের উদ্ভাবিত ফসল। রং, স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধ বিবেচনায় নিয়ে কৃষকই নাম রেখেছে লালমি। কৃষি বিভাগ এ ফসলের নামকরণসহ অধিক মূল্যায়ন ও উন্নয়নের জন্য শুরু করেছে গবেষণা।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফরিদপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, লালমি বাঙ্গিসদৃশ একটি ফল। ফরিদপুরে উৎপাদিত ১৮টি ফলের মধ্যে আর্থিক বিবেচনায় বাঙ্গি ও লালমির অবস্থান পাঁচ নম্বরে। তিনি বলেন, ‘এই ফল এই এলাকার কৃষকেরাই উৎপন্ন করেছেন। তবে আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে গবেষণা করে এই ফসলের চাষ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে।’
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, লালমি জেলার সদরপুর উপজেলায় ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হয়। তবে সদরপুরসংলগ্ন নগরকান্দা, ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসন উপজেলার কিছু অঞ্চলেও ধীরে ধীরে এই ফলের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর ফরিদপুরে ৫৮৪ হেক্টর জমিতে লালমির চাষ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সদরপুরেরই ৫৬০ হেক্টর জমি। প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে লালমির উৎপাদন হয় ১৫ থেকে ১৬ মেট্রিক টন। সে হিসেবে, জেলায় এবার লালমি উৎপাদন হবে কমবেশি ৯ হাজার মেট্রিক টন। এই লালমি বিক্রি করে জেলার কৃষকেরা ৫০ কোটি টাকার মতো পাবেন।
ফরিদপুরের সদরপুরে লালমির চাষ শুরু হয়েছে প্রায় ১৫ বছর আগে থেকে। ওই এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদরপুরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের যাত্রাবাড়ী এলাকার আলিম খাঁ নামে এক কৃষক প্রথমে লালমি চাষ করেন। তাঁর সাফল্য দেখে অন্য কৃষকেরাও লালমি চাষে উৎসাহিত হন। বছরের প্রায় যেকোনো সময়ে লালমি চাষ করা যায়। আবার রমজান মাসে লালমির চাহিদা অনেক বেশি থাকে। তাই কৃষক রমজান মাসকে সামনে রেখে লালমি চাষ করেন। লালমি হালকা পানীয় জাতীয় ফসল। খাওয়ার পর সহজেই শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। এ কারণে সারা দিন পানাহার থেকে বিরত থাকার পর সন্ধ্যায় ইফতারের সময় এক গ্লাস লালমির রস শরীরকে দ্রুত সতেজ করে তোলে।
সদরপুরের ভাষাণচর ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকার কৃষক মোজাফফর মোল্লা জানান, লালমি চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়েও বিঘাপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে। এ বছর তিনি ২৬ শতাংশ জমিতে লালমি চাষ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। তাই ভালো লাভ থাকবে বলে আশা তাঁর।
নগরকান্দার রামনগর এলাকার কৃষক বদরউদ্দিন প্রামাণিক এ বছর তিনি ৭৫ শতাংশ জমিতে লালমি চাষ করেছেন। গত বছরও সমপরিমাণ জমিতে চাষ করেছিলেন। সেবার লাভ করেছিলেন ৬০ হাজার টাকা।
সদরপুরের নতুন বাজার ও নগরকান্দার গোপালপুর বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে লালমি। কৃষক খেত থেকে লালমি তুলে ঝুড়িতে ভর্তি করে নিয়ে আসছেন বাজারে। নারী ও শিশুরা পানি দিয়ে প্রতিটি লালমির গা থেকে ধুলাবালি দূর করে পরিষ্কার করছেন। এসব এলাকায় এখন এমন কোনো বাড়ি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যারা লালমির চাষ করেনি।
সদরপুর উপজেলার সবচেয়ে বড় হাট বসেছে কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কাটাখালী, মটুকচর, নতুন বাজার ও বাঁধানোঘাট এলাকায়। এ ছাড়া পিয়াজখালী, আকোটেরচর, কারীরহাট, বিষ্ণুপুরসহ একাধিক জায়গায়ও বসেছে লালমির হাট। এর মধ্যে কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের হাটগুলো সবচেয়ে বড় এবং বেচাকেনা বেশি ।
নতুন বাজার এলাকার ব্যাপারী শাহজাহান মৃধা (৪৯) বলেন, প্রতিদিন এই অঞ্চল থেকে ২৫ থেকে ৩০ ট্রাক লালমি ঢাকায় পাঠানো হয়। তাঁর সহযোগী ফারুক মৃধার মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সেগুলো বিক্রি করেন।