জেলহত্যার ৪৬ বছর

কুশীলব কারা, বের করতে তদন্ত কমিশন চায় পরিবার

সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামির ১০ জনই পলাতক। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাজেদের ফাঁসি গত বছর কার্যকর হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়।

ষড়যন্ত্র, ক্ষমতা দখল-পাল্টাদখলের ধারাবাহিকতায় ৪৬ বছর আগে কারাগারে বন্দী অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলা জেলহত্যা মামলা নামে পরিচিতি পায়। এ মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হলেও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত, তা এখনো বের করা যায়নি বলে মনে করেন জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, আগামী প্রজন্ম ও ইতিহাসের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত ও নেপথ্যের কুশীলব বের করতে তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতাকে। তাঁরা হলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। নির্মম এ ঘটনার আড়াই মাস আগে দেশের ইতিহাসে নৃশংসতম ঘটনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়।

জাতীয় চার নেতার অন্যতম তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি এখন জাতীয় সংসদের সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেসব হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রের কাঠামো বদলে দেয় বা রাষ্ট্রের মূল ভাবধারাকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে, সেসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও বের করা প্রয়োজন। আগামী প্রজন্ম ও ইতিহাসের স্বার্থেই বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত ও নেপথ্যের কুশীলব বের করতে তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

জেলহত্যা মামলায় আদালতের রায়ে ৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও ৮ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাঁদের মধ্যে ১০ জন এখনো পলাতক। অপর আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। গত বছরের ৬ এপ্রিল তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জেলহত্যা মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। মাজেদ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। গত বছরের ১১ এপ্রিল দিবাগত রাতে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

জেলহত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি হলেন রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধা। এই তিন আসামি এখন কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। তথ্য আছে কেবল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুজনের ব্যাপারে। এর মধ্যে কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় এবং লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তাঁকে দেশে ফেরাতে কানাডায় আইনি লড়াই চালাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে রাশেদ চৌধুরীও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরাতে কয়েক বছর ধরেই মার্কিন প্রশাসনের নানা স্তরে অনুরোধ জানিয়ে আসছে সরকার।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক আসামি যাঁরা বিদেশে আছেন, তাঁদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাধা পেরিয়ে যতক্ষণ না ওই আসামিদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

জেলহত্যায় লালবাগ থানায় মামলা ও রায়

জেলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় সেনাবাহিনীর রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করা হয়। মামলায় বলা হয়, মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে গুলি করেন এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। ঘটনার পরদিন মামলা হলেও এই মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।

জেলহত্যার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি—রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১২ আসামি হলেন লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম এবং ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।

পরে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পান। এ ছাড়া আপিল করা চার আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে।

হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিল বিভাগ ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল রায় দেন। রায়ে দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে খালাস করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়।