কুমিল্লা নগরের ছোটরা এলাকার এক প্রকৌশলীর ছেলে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে ছিলেন প্রথম। তিনি কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ১৯৯৫ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে এসএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৮তম স্থান অর্জন করেন। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। এক রাতে কুমিল্লা শহরতলির দৌলতপুর এলাকায় মাদক সেবন করতে গেলে পুলিশ তাঁকে ধাওয়া দেয়। তিনি পুকুরে ঝাঁপ দেন। পরদিন সকালে পুকুরে তাঁর লাশ ভেসে ওঠে।
মুখে কাপড় বেঁধে হাতে ছুরি নিয়ে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার আদালতে প্রবেশ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের এক সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) মাদকাসক্ত ছেলে। নেশায় বুঁদ হয়ে ওই তরুণ বিচারকের দিকে ছুরি নিয়ে তেড়ে যান। পরে পুলিশ এসে তাঁকে আটক করে।
এমন আরও অনেক মাদকসেবী আছেন এই কুমিল্লায়। এই সন্তানদের নিয়ে অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যরা অতিষ্ঠ। নগরের ২০টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে মাদকবিরোধী অভিযানে চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল থেকে ৬ জুন পর্যন্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের হাতে পাঁচজন মাদক ব্যবসায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন দুজন। র্যাবের হাতে এ সময় তিনজন মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। গত বছরের জুনে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৪ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। আরেকজন গাড়িচাপায় মারা যান। মাদকাসক্ত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, যাঁরা মাদক কেনাবেচা করেন এবং পৃষ্ঠপোষকতায় জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হোক।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন বলেন, কুমিল্লার মানুষ সহজে মাদক পেয়ে যায়, যে কারণে এখানে মাদকাসক্তের সংখ্যা বেশি। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী মাদকবিরোধী অভিযান করে আসছে। মাদকের ‘উত্সমুখ’ বন্ধ করতে হবে। সীমান্ত দিয়ে কোনোভাবেই যেন মাদক ঢুকতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সন্তানকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে সবার আগে পরিবার ও অভিভাবকদের ভূমিকা রাখতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগর ও শহরতলির যেকোনো এলাকায় হাত বাড়ালেই মেলে মাদকদ্রব্য। নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েন তরুণ থেকে বৃদ্ধরাও। তাঁদের মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই বেশি। মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে কেউ কেউ ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েন। মাদকসেবীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে গোটা পরিবার। থানায় এ নিয়ে অভিযোগও কম হয়নি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নগরের শাসনগাছা, ধর্মপুর, রেলস্টেশন, বাদশা মিয়ার বাজার, জিলা স্কুলের উত্তর পাশের চিকিত্সাকেন্দ্র, ঠাকুরপাড়া, তালপুকুর পাড়, দক্ষিণ চর্থা, ভাটপাড়া, চকবাজার, নূরপুর, কাপ্তানবাজার, শুভপুর এলাকা ও শহরতলির চানপুর এবং গোলাবাড়ি এলাকা থেকে মাদকসেবীরা মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করেন। কুমিল্লায় মাদকসেবীদের বেশির ভাগই ফেনসিডিলে আসক্ত।
নগরের কান্দিরপাড় ঈশ্বর পাঠশালা এলাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষক বলেন, ‘১০ বছর আগে আমি আমার ভাইকে হারাই। নেশার টাকার জন্য সে পাগল হয়ে যেত। একদিন রাতে অতিরিক্ত নেশা করে মারা যায় সে। ওই দুঃখ এখনো আমরা ভুলিনি।’
আরেক অভিভাবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘গাঁজার টাকা না দিলে আমার সন্তান পুরো ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। ওই কারণে বাসায় কোনো আত্মীয়স্বজন আসেন না। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না।’