স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

কিসিঞ্জারের সফর ও ভারতের শঙ্কা

একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন মঈদুল হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন মূলধারা’ ৭১ এবং উপধারা একাত্তর, মার্চ-এপ্রিল নামে দুটি বই। বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখছেন আরও একটি বই। তাঁর প্রকাশিতব্য সেই বইয়ের ত্রয়োদশ অধ্যায়ের শেষ কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।

মঈদুল হাসান
মঈদুল হাসান

জুলাইয়ে সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য এবং কমান্ড ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে মেজর খালেদ মোশাররফ বাদে অপর সেক্টর কমান্ডাররা একটি বিকল্প কমান্ড ব্যবস্থা গঠনের উদ্যোগ নেন। সবাই প্রস্তাব করেন, কনে৴ল ওসমানীকে দেশরক্ষামন্ত্রী পদে উন্নীত করে সাতজন সেক্টর কমান্ডারের সমন্বয়ে একটি ‘যুদ্ধ কাউন্সিল’ গঠন করা হবে এবং সেই কাউন্সিলের হাতেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সমগ্র দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। কর্মরত কর্মকর্তাদের মধে৵ পদমর্যাদায় সর্বাপেক্ষা প্রবীণ বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে এই যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করার প্রস্তাব ওঠে। ১০ জুলাই সম্মেলন শুরু হওয়ার কিছু আগে কনে৴ল ওসমানী বিষয়টি অবহিত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সব দায়দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেন।

শিবিরে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা

ফলে হঠাৎ এক সংকটের আবহাওয়া তৈরি হয়, বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ যখন সবে শুরু হতে চলেছে। সেই অবস্থায় ওসমানীর মতো প্রবীণ ও সুপরিচিত সেনাপতির পদত্যাগ মুক্তিযুদ্ধ-সমথ৴কদের মধে৵ বিরাট ভুল বার্তা দিতে পারত। এ ছাড়া ওসমানী ছিলেন আওয়ামী লীগেরই প্রথম সারির নেতা। বিগত নির্বাচনে তিনি দলের একজন বিজয়ী জাতীয় পরিষদ সদস্য। তাঁর পরিবর্তে যিনি বা যাঁরা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন, তাঁর বা তাঁদের ওপর রাজনৈতিকভাবে নির্ভর করা যাবে কি না, এ প্রশ্ন আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধে৵ ওঠা ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক। কাজেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ওসমানীকে নেতৃত্ব পদে ধরে রাখা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ-ও মনে করতেন, সেক্টর কমান্ডারদের অভিযোগের যৌক্তিকতা রয়েছে। কাজেই কমপক্ষে তাঁদের জন্যও কাজের পরিসর ও সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা, যাঁরা পাকিস্তানের ক্রমবধ৴মান সামরিক আক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনা করে মাঠপর্যায়ের জরিপে বাংলাদেশ বাহিনী (মুক্তিফৌজ) সম্প্রসারণে তাঁদের সহায়তার পরিমাণ কী হতে পারে, তাঁরা সে বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান।

ভারতের জরিপ দল জুন মাসে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাবেক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী (এফএফ) উভয়ের সম্প্রসারণেই ভারতের সাহায্য প্রয়োজন।

বাংলাদেশ বাহিনী সম্প্রসারণের উদ্যোগ

২৫-২৬ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের আগে ইবিআর যখন পাকিস্তানের অধীনে ছিল, তখন তা গঠিত ছিল মোট আট ব্যাটালিয়নে এবং তা ধরে নেওয়া হতো নিয়মিত এক ডিভিশন হিসেবেই। মার্চে আক্রমণ শুরু করার আগে তিন ব্যাটালিয়নকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে যে পাঁচ ব্যাটালিয়ন সেনা ছিলেন, যুদ্ধে তাঁদের মধে৵ অনেকে নিহত হন। ভারতের জরিপ দলের রিপোর্টে বলা হয়: ‘যোদ্ধাদের ঘাটতি তারা ইতিমধে৵ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরাট অসুবিধাই হলো অস্ত্রশস্ত্রের ঘাটতি। তাদের দরকার পুরো এক ডিভিশন। অতিরিক্ত চার ব্যাটালিয়ন গড়ে তোলা প্রয়োজন নতুন রিক্রুট করে। এর মধে৵ থাকবে একটা সাঁজোয়া ব্যাটালিয়ন, যার সব রকম সরবরাহ মজুত থাকবে, যেমন আটি৴লারি, বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র এবং ট্যাংকবিধ্বংসী কামান।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল ৭ জুলাই, সেক্টর কমান্ডারদের সভার মাত্র তিন দিন আগে। কখন, কীভাবে এই রিপোর্টের বিষয় তাজউদ্দীনের কাছে পৌঁছেছিল, তা এই লেখকের জানা নেই, তবে ভারতের দুজন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষস্থানীয় নীতি উপদেষ্টা পি এন হাকসার এবং কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ইন-সি জগজিৎ সিং অরোরা, যাঁদের কোনো একজন এই সংবাদ তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সম্মেলনের প্রথম দিন প্রধান সেনাপতি এবং সেক্টর কমান্ডারদের মতবিরোধ দূর করার জন্য সারা দিন নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালান। এই প্রচেষ্টা যে ভারতের সামরিক নজরদারির বাইরে ঘটেছিল, তা মনে করার কারণ নেই। কেননা, সম্মেলনস্থলটি ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধান অফিস ৮ থিয়েটার রোডসংলগ্ন লর্ড সিনহা রোডের ওপর অবস্থিত বিএসএফের বিশাল দপ্তরে। সম্ভবত দ্বিতীয় দিন তাজউদ্দীন ভারতের কর্তৃপক্ষ মহল থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথে৵র ভিত্তিতে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ বাহিনী সম্প্রসারণের এক উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি প্রকাশ করেন। ফলে সম্মেলনের আবহাওয়ায় দ্রুত উন্নতি ঘটে।

দায়িত্ব বণ্টন ও পদোন্নতি

তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ বাহিনীর দ্রুত সম্প্রসারণ তদারকির স্বার্থে ওসমানীর সহযোগিতা কামনা করেন। ওসমানী তাঁর পদত্যাগপত্র তুলে নেন। সেক্টর কমান্ডাররাও তাঁদের বিকল্প কমান্ড কাঠামো গঠনের দাবি স্থগিত করে চারটি নতুন ব্যাটালিয়ন গঠন এবং একটি ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার দিক সাগ্রহে পা বাড়ান। পরের মাসে আরও দুটি ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছিল একটি বিশাল লক্ষ৵। রাতারাতি এসব সেক্টর কমান্ডারকে পদোন্নতি দিয়ে লেফটেন্যান্ট কনে৴ল বানানো হয় এবং নতুন ব্যাটালিয়নের জন্য নতুন লোকবল রিক্রুট করা থেকে শুরু করে তাঁদের ট্রেনিং এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ যোদ্ধায় পরিণত করার বিশাল দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হয়। অথচ তাঁদের বরাবরই পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল কোম্পানি পরিচালনা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।

পরবর্তী চার দিনে বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা পুননি৴র্ধারণ, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন তৎপরতার উপায় অন্বেষণ, এই উদ্দেশে৵ সেই সব স্থানে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের উপায় উদ্ভাবন এবং গেরিলা ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে দেখা হয়। এ ছাড়া ছাত্র ও যুবকদের সমবায়ে গঠিত ‘গণবাহিনী’ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের (এফএফ) কীভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে সম্পর্কেও কিছু আলোচনা হয়। সংগত কারণেই পাঁচ দিনের অধিকাংশ সময় আলোচনা চলে সেনাবাহিনীর নতুন সম্প্রসারণের বিভিন্ন দিক নিয়ে এবং কিছু সময় আক্রমণ কৌশলের বিষয় নিয়ে। কিন্তু দুটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় আলোচনায় কার্যত বাদ পড়ে।

আলোচনার বাইরে দুটি বিষয়

প্রথমটি ছিল বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডকে উন্নত করে এমন কর্মক্ষম ব্যবস্থায় পরিণত করা, যার ফলে প্রতিটি সেক্টরের সঙ্গে সরাসরি গোপন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়। এই বিষয়টিই ছিল সেক্টর কমান্ডারদের সাম্প্রতিক অসন্তোষের মূল কারণ। সেক্টরগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কোনো উপায় না থাকায় কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে সেক্টরগুলোকে নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের চিন্তা ছিল অবাস্তব। সেক্টরের পক্ষেও ঊর্ধ্বতন কমান্ডের সময়োপযোগী পরামর্শ, সহায়তা ও সরবরাহের অভাবে শুধু নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করা ছাড়া অন্য উপায় থাকত না।

সম্মেলনের দ্বিতীয় বৃহৎ দুর্বলতা ধরা পড়ে সম্মেলন শেষ হওয়ার পর, যখন দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেদের সেনাসংখ্যা ও সরবরাহ বাড়ানোর নানা সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোনো সামগ্রিক সমর পরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয় বিবেচনা করা হয়নি। যোগদানকারী প্রায় সবার কমবেশি ধারণা ছিল, পাকিস্তানকে পরাজিত করার জন্য যে বিশাল সমরশক্তির প্রয়োজন, তার বড় অংশই জোগান দিতে হবে ভারতকে। কিন্তু তাদের সহায়তাকে সফল করার জন্য বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের কতখানি দায়িত্ব কোন কোন অংশে কার্যকর করতে হবে, সে সম্পর্কে কোনো অর্থবহ আলোচনা শুরু করা হয়নি। পূর্ব বাংলার ভূবৈচিত্র্য এবং পাকিস্তানি সেনাদের মনস্তাত্ত্বিক গঠন ও সমরকৌশলের সঙ্গে বিদ্রোহী বাঙালি সেনারা তুলনামূলকভাবে অধিক পরিচিত থাকায় এবং সম্মুখযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের হতোদ্যম ও পরিশ্রান্ত করার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদেরই তুলনামূলক অধিক সুযোগ থাকায় এসব ক্ষেত্রে কার্যকর সমর পরিকল্পনা প্রণয়নে বাংলাদেশের অধিক ফলপ্রসূ হতে পারত।

বাংলাদেশের নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী চার-পাঁচ মাসে পাকিস্তানকে কতখানি বেকায়দায় ফেলা সম্ভব ছিল এবং চূড়ান্তভাবে তাঁদের পরাভূত করার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতের কতখানি সহায়তা প্রয়োজন হতো, তেমন অনুসন্ধানের সুযোগ যা ছিল, তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বাহিনী হয়তো এক যৌথ সমর পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারত। যৌথ সমর পরিকল্পনা প্রণয়নে অনাগ্রহ এবং কার্যকর কেন্দ্রীয় কমান্ড ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অক্ষমতা—এই দুই দুর্বলতার প্রভাব ছিল মুক্তিযুদ্ধে।

নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি

অবশ্য সেই সময়ের অপরাপর ঘটনা সমাবেশের একটি নিজস্ব গতি ও চাপ অন৵ রকম ছিল। বাংলাদেশের নিয়মিত ও অনিয়মিত যোদ্ধাদের সমরশক্তি সংহত ও প্রয়োগ করা ছিল অপেক্ষাকৃত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

কিন্তু অন্য নানা ঘটনা এগিয়ে চলেছিল দ্রুতগতিতে। যেমন ৬ জুলাই থেকে পরবর্তী পাঁচ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ঝড়ের গতিতে ভারত, পাকিস্তান ও চীন সফর করে এক নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে কিসিঞ্জারের এই সফরের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে ভারত সরকার এমন উপলব্ধিতে পৌঁছায় যে এর ফলে এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য তাঁদের জন্য এক বিপজ্জনক মোড় নিয়েছে। এত দিন তাঁদের কেউ কেউ মনে করতেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহায়তায় শরণার্থী সংকট নিষ্পত্তি হয়তোবা সম্ভব হবে। কিসিঞ্জারের এই সফরের পর তাঁদেরও আশঙ্কা হয় যে পাকিস্তান চীনের সহযোগিতায় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পূর্বাপেক্ষা প্রস্তুত এবং মাকি৴ন সরকার সে ক্ষেত্রে ১৯৬৩ সাল থেকে অনুসৃত ভারত সমর্থনের নীতি পরিবত৴ন করে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে। এই বিপদাশঙ্কার মুখে ভারত সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ে, এককভাবে তাদের নিজেদের সম্পদ সমরশক্তি সংহত করার কাজে। (শেষ)