কিশোরীরা নিজেরাই বানাচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিন

রাজধানীর পুরান ঢাকায় চানখাঁরপুলের কাছে নতুন মাজেদ সর্দার সড়কে আশ্রয়কেন্দ্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাচ্ছে কিশোরীরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
রাজধানীর পুরান ঢাকায় চানখাঁরপুলের কাছে নতুন মাজেদ সর্দার সড়কে আশ্রয়কেন্দ্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাচ্ছে কিশোরীরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

মেঝেতে চাদর বিছিয়ে গোল হয়ে বসে কিশোরীরা কিছু একটা বানাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, তারা সাদা গজ, তুলা কেটে রিং (গেঞ্জি কাপড় দিয়ে বানানো) দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাচ্ছে। প্রয়োজনের সময় তারাই এটি ব্যবহার করবে।

এই কিশোরীদের বেশির ভাগই এক সময় পথশিশু হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার। কারও মা, বাবা আবার বিয়ে করেছে। সৎ মা বা সৎ বাবা বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। তখন পথই হয়েছে ঠিকানা। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে গৃহকর্তার মাধ্যমে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে কেউ কেউ। এরই মধ্যে বয়ঃসন্ধিকাল পার হয়েছে। স্বাস্থ্যগত ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো সচেতনতা ছিল না।

এই কিশোরীরা এখন আর পথশিশু নয়। তাদের ঠিকানা বেসরকারি সংগঠন অপরাজেয় বাংলাদেশ পরিচালিত ড্রপ ইন সেন্টার বা শেল্টার হোম। রাজধানীর পুরান ঢাকায় চানখাঁরপুলের কাছে নতুন মাজেদ সর্দার সড়কে রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রটি। সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফের সহায়তায়।

কিশোরীরা এখন স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সচেতন। তারা এখন স্যানিটারি ন্যাপকিনও বানাচ্ছে। একেকটা ন্যাপকিনের পেছনে সংস্থার খরচ হয় সাড়ে চার টাকা। মাসিকের সময় ছয় ঘণ্টা পরপর কিশোরীরা এই ন্যাপকিন বা প্যাড পরিবর্তন করে।

এক কিশোরী বলে, ‘মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার করতাম। শুকাইতে পারতাম না বলে মাঝে মধ্যে ভিজা কাপড়ই পরতাম। এইখানে আসার পর প্রথম দিকে টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করতাম। পরে এক ডাক্তার আপা আমাদের বলেন, টিস্যু ব্যবহার করলে তা শরীরের ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর জরায়ু ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখন নিজেদের প্যাড নিজেরাই বানাই।’

আশ্রয়কেন্দ্রের কিশোরীরা এখন বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানে। এসব নিয়ে তারা খোলামেলা কথা বলে। কিশোরী রিপা বলে, ‘এখন আর বয়ঃসন্ধিকালে নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পাই না। ভয় লাগে না।’

শিশু প্রতিনিধি আরিফা জাহান পাঁচ বছর ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। বাবার বহুবিবাহের কারণে আরিফা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। পরে সে এখানে আসে। আরিফা জানাল, এখানে আসার আগে মাসিকের সময় পুরোনো নোংরা কাপড় ব্যবহার করত। এখন নিজের বানানো প্যাড ব্যবহার করে।

নিজেদের বানানো পুতুল হাতে কিশোরীরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

২০০৮ সালে আশ্রয়কেন্দ্রের শুরু। ব্যবস্থাপক রোকসানা বেগম শুরু থেকে এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, পথশিশু বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অবহেলিত শিশুদের দোষের অন্ত নেই। এলাকায় কিছু হলেই এই শিশুদের নাম দেওয়া হতো। এখন প্রতিদিন রাতে বংশাল থানাকে জানানো হয়, রাতে মোট কতজন শিশু ঘুমাচ্ছে। পুলিশ এসে দেখে যায়।

স্যানিটারি প্যাড বানানো প্রসঙ্গে রোকসানা বেগম বলেন, ‘এদের সঙ্গে কাজ না করলে এদের মধ্যে যে কত প্রতিভা তা বোঝা যাবে না। বাজারে কিনতে পাওয়া যায় সে ধরনের একটি প্যাডের স্যাম্পল দিয়ে এদের দেখিয়ে দেওয়ার পর থেকে নিজেরাই তা বানানো শিখে গেছে। বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন কোম্পানির প্যাডের দাম অনেক বেশি। কম খরচে তারা এখন নিজের বানানোটাই ব্যবহার করছে।’

অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে সহায়তা করার জন্য দাতাগোষ্ঠী, বিজিএমইএসহ অনেককে বলেছি। তবে সেভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন মেয়েরা নিজেরাই প্যাড বানাচ্ছে। কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা বলেছেন মেয়েদের বানানো প্যাড স্বাস্থ্যসম্মত। এখন বিভিন্ন ব্যাংক বা কোম্পানি মেয়েদের এই উদ্যোগকে আরও একটু এগিয়ে নিতে সহায়তা করতে পারে। এই মেয়েদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে।’

আশ্রয়কেন্দ্রে ভালোই আছে এই কিশোরীরা। তারা এখন দল বেধে স্কুলে যায়। একজন এবার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এসএসসি) দেবে। কেউ কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। শিশু উন্নয়ন ব্যাংকে বেতনের টাকা জমাচ্ছে। পড়াশোনার ফাঁকে তারা পুতুল, ফুল, চটের ব্যাগ বানায়। গান-নাচ শেখে। ক্রিকেট খেলে। তারা এখন স্বপ্ন দেখে।

কিশোরীদের অতীত গোপন রাখা হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। এখানে ছয় বছর থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত থাকার সুযোগ পায় কিশোরীরা। পরে সংগঠনের সহায়তায় বিউটি পারলার, বোতাম বানানো, পোশাকশিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। যাদের পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়, তারা ফিরে যায়। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিয়ের দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে না। চাকরি করে একসময় নিজেরাই বিয়ে করে। বছরে ১০০ জন কিশোরীকে বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা হয়।

আশ্রয়কেন্দ্রে খাচ্ছে কিশোরীরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন