কয়েক বছর ধরে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। ঈদের ছুটিতে এমন দুর্ঘটনা ও মৃত্যু আরও বাড়ে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বড় একটা অংশই কিশোর ও উঠতি বয়সী তরুণ। নিয়ম না মেনে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোয় সড়কে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছে এসব তরুণ প্রাণ।
ঈদের তিন দিনে দেশের পাঁচটি স্থানের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যে ১০ জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের সবার বয়স ১৮ বা তার নিচে। নিহত তরুণদের কেউ চালক, কেউবা ছিলেন আরোহী। এসব কিশোর–তরুণদের সবাই ঈদ উদ্যাপন করতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন।
সন্তানদের আবদার মেটাতে কম বয়সী ছেলেদের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দেওয়ায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। এবারের সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই শহরের বাইরে গ্রামের সড়কগুলোতে ঘটেছে। কিশোরদের বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোই এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকেরা।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, গত ২৯ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত সাত দিনে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই (৩১ জন) মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী।
ঈদের তিন দিন (গত মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার) পঞ্চগড়, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, ঢাকার সাভার ও ময়মনসিংহে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১০ কিশোর ও উঠতি বয়সী তরুণ নিহত হয়েছেন। তাঁদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। ঈদের ছুটিতে এই পাঁচ স্থানে সড়ক দুর্ঘটনাও ছিল বেশি।
ঈদের পরের দিন গত বুধবার বিকেল চারটায় পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের পুকুরীরডাঙ্গা-বালুরঘাট এলাকায় তালমা-মডেলহাট সড়কে নিহত হয় তিন কিশোর। মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল তারা। তাদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা অপর একটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল।
নিহত তিনজন হলো হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জিয়াবাড়ি-খালপাড়া এলাকার মাহবুবার রহমান ওরফে শিশির (১৭), আবু বক্কর সিদ্দিক (১৬) ও সিয়াম ইসলাম ওরফে নতুন (১৬)। তাদের মধ্যে মাহবুবার হাফিজাবাদ দ্বারিকামারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে, আবু বক্কর একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়ত। আর সিয়াম নতুন হাফিজাবাদ দ্বারিকামারি উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ঢাকায় তার ভাইয়ের দোকানে কাজ করত।
পরের দিন বৃহস্পতিবার পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ-সোনাহার সড়কের ধরধরা সেতুতে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুর রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে ইশাদের (১৪) মৃত্যু হয়। সে স্থানীয় জমির উদ্দিন দাখিল মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মোটরসাইকেলটিতে থাকা আরও দুই আরোহী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
অভিভাবকেরা যদি তাঁদের কম বয়সী ছেলেদের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দেওয়া বন্ধ করেন, তাহলে হয়তো আমাদের এ ধরনের দুঃসংবাদ শুনতে হবে না বলে মন্তব্য করেছেন পঞ্চগড় নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হেলমেট ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে শহরে পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়। এ জন্য হয়তো শহরে দুর্ঘটনা কিছুটা কমেছে। তবে গ্রামের সড়কগুলোতে যেভাবে বেপরোয়া গতিতে কিশোরেরা মোটরসাইকেল চালায়, এটা বন্ধ করতে পরিবারের ভূমিকাই সবেচেয়ে বেশি।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, এবার যতগুলো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর প্রায় সব কটিই প্রত্যন্ত গ্রামের সড়কগুলোতে ঘটেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই কিশোর।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মোটরসাইকেলে ভাগনিকে নিয়ে বোনের বাসায় যাচ্ছিল দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার জগন্নাথপুর কলেজপাড়ার সেলিম রানা (১৪)। মাথায় হেলমেট ছিল না সেলিমের। পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে সেলিম। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে তার মৃত্যু হয়। সে চক কাঞ্চন হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল।
নিরাপদ সড়ক চাই দিনাজপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক হারুন উর রশিদ বলেন, শুধু অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়ের কারণে কিশোর–তরুণেরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
গত মঙ্গলবার ঈদের দিন সন্ধ্যায় সিরাজগঞ্জের তাড়াশ-রাণীনগর আঞ্চলিক সড়কের পেঙ্গুয়ারী মোড়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই বন্ধু মেহেদী হাসান (১৮) ও রাকিব হোসেন (১৮)। মেহেদী ও রাকিব দুজনই একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। মোটরসাইকেলটিতে তাঁরা তিন বন্ধু ছিলেন। অপর বন্ধু রনি ইসলাম চিকিৎসাধীন।
ঈদের দিন বিকেলে সাভারের ধামরাইয়ের সূয়াপুর এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় নিহত হয় মোটরসাইকেলচালক মেহেদী হাসান ওরফে সিয়াম (১৭)। সে সাভারের আউকপাড়া আদর্শগ্রামের বাসিন্দা ছিল। মোটরসাইকেলে মেহেদীর এক বন্ধুও ছিল। সে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় তিন বন্ধু এক মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিল। বেপরোয়া গতির কারণে মোটরকাইকেলটি পিকআপ ভ্যানের নিচে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় দুই বন্ধু। গুরুতর আহত অপরজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। উপাজেলার শিবপুর-ফুলবাড়িয়া সড়কে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত দুজন হলেন ফুলবাড়িয়ার চক রাধাকানাই গ্রামের আবদুল হান্নান (১৮) ও নয়ন আহমেদ (১৮)। দুজনই ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদরের একটি বেসরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।
নিরাপদ সড়ক চাই ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি আবদুল কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি, মোটরসাইকেলচালকের লাইসেন্স ছিল না। এ ছাড়া বন্ধুদের কারও মাথায় হেলমেট ছিল না। এ ছাড়া সড়কে খড় শুকাতে দেওয়া সড়কটির ওই অংশও পিচ্ছিল ছিল।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার; প্রতিনিধি, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ)]