একবার শিক্ষাসফরে গিয়ে মেডিকেলের এক সহপাঠী পাহাড় দেখে আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিল, ‘পাহাড় দেখিলে তাহার কথা মনে পড়ে...।’ এরপর থেকে তার নাম হয়ে গেল ‘পাহাড় দেখিলে তাহার কথা মনে পড়ে...।’
যাহোক। ভারতের লাদাখ ভ্রমণে দুর্গম জজিলা গিরিপথে যেতে বিশাল সব পাহাড় দেখে আমার কাহার কথা মনে পড়েছিল মনে নেই। তবে ভয়ংকর ওই ভ্রমণে নিজের নামটাও যে ভুলে গিয়েছিলাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লেখার আগে জম্মু–কাশ্মীরের লাদাখ সম্পর্কে একটু জেনে নিই।
লাদাখ বা লা-দ্বাগস ( তিব্বতি শন্দ) অর্থ ‘গিরিবর্তের দেশ’। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত কুনলুলু ও হিমালয় পর্বতঘেরা এ অঞ্চল (এখন আলাদা কেন্দ্রশাসিত রাজ্য)। লেহ ও কারগিল জেলা নিয়ে লাদাখ গঠিত। জনবিরল এলাকা। লাদাঘ তিব্বতি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চল। মুসলিম বা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। এদের ভাষা উর্দু ও লাদাখি ভাষা।
লাদাখ নামটি শুনেই বোঝা যায় এটি পাহাড়ি এলাকা। ঝরনা, নদী, পাহাড়, বরফচূড়া, উপত্যকা, ঘন অরন্য—সব মিলে শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক ছবি! অথচ এ স্বর্গসম ভূমি আজ এক রক্তাক্ত প্রান্তর। এ বছরের ১৫ জুন লাদাখে ঘটে গেল ভারত ও চীন মধ্যকার স্মরণকালের ভয়াবহ সংঘর্ষ। এতে উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারসহ দুপক্ষের বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমে এসব সহিংসতার খবর দেখে আমার দেখা লাদাখ ভ্রমণের স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
আহা কাশ্মীর! অপার্থিব সম্মোহনী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। এর রাজধানী শ্রীনগরসহ ডাল লেক, পহেলগাঁও, গুলমার্গ, সোনমার্গ প্রতিটা জায়গা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য, ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
কিন্তু লাদাখের জজিলা পাস (Zoji -La) বা জজিলা গিরিপথে জিরো পয়েন্ট ভ্রমণ একেবারেই আলাদা এক অভিজ্ঞতা। জজিলা পাস উঁচু গিরিশৃঙ্গে অবস্থিত পৃথিবীর প্রথম দশটি বিপজ্জনক পথের একটি। এশিয়ার মধ্যে এক নম্বর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচুতে পাহাড় কেটে তৈরি এই জজিলা পাসের দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার। গিরিপথটি ঝুঁকিপূর্ণ, উচ্চতাজনিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং কিছুটা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে এদিকে পর্যটকসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
এই জজিলা জিরো পয়েন্টেই সংঘটিত হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান মধ্যকার ঐতিহাসিক ‘কারগিল যুদ্ধ’। জজিলা পাস দিয়ে কাশ্মীর থেকে অস্ত্র ও সৈন্যদের খাবার নিয়ে যাওয়া হতো যুদ্ধক্ষেত্রে। হাজারো মৃত্যুফাঁদ পাতা সূক্ষ আঁকাবাঁকা কত ভয়ংকর, ওখানে না গেলে কেউ তা কল্পনা করতে পারবেন না।
এক মনোরম ভোর। ‘দুর্বার গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাপার...’ বানীতে উদ্দীপ্ত পাঁচ সদস্যের আমাদের ভ্রমণদল শ্রীনগর থেকে কারগিলের উদ্দেশে রওনা হলাম। প্রথমে কারগিলের সোনমার্গ ও পরে মূল গন্তব্য জজিলা জিরো পয়েন্ট। এই ভ্রমণের সঙ্গীরা প্রায় সবাই পঞ্চাষোর্ধ্ব। বয়স যা–ই হোক, ‘আমরা নবীন দল’ পৃথিবীর উচ্চতম গিরিশৃঙ্গের অন্যতম একটিতে যাচ্ছি। আমরা রোমাঞ্চিত, উত্তেজিত।’
জজিলা জিরো পয়েন্ট ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ২৫০ কিলোমিটার এবং কারগিলের সোনমার্গ থেকে ২৫ থেকে ৩০ কিলো দূরে। শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ এসে ৬০০০ রুপি ভাড়ায় পাহাড়ি পথের জন্য নির্ধারিত একটি জিপে আমরা উঠে বসি। অক্টোবরের সবে শুরু তখন। কিন্তু এর মধ্যেই শীত জেঁকে বসেছে। সবার পরনে ভারী কাপড়। উল্লেখ্য, নভেম্বর পরবর্তী ছয় মাস এ অঞ্চল ৫০ থেকে ১০০ ফুট বরফে ঢাকা থাকে। তখন এখানে সব যাতায়াত বন্ধ।
আমাদের গাড়িচালক আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী এক ঝকঝকে তরুণ। শরীরে অপুষ্টির ছাপ। পরনে মলিন পাতলা জ্যাকেট, জীর্ণ কানটুপি। বোঝা যাচ্ছে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকা মূলত পর্যটননির্ভর। নিপুণ দক্ষতায় অল্প বয়সী এই ছেলেটি কঠিন পাহাড়ি দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে নিরাপদে ঘুরে এল।
জজিলা পাস বা জজিলা গিরিপথ কিন্তু যথেষ্ট সরু, যাতে দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে না। পুরো পথ নুড়ি পাথর বিছানো। মাঝেমধ্যে কয়েক জায়গায় গর্তও আছে। কাজেই ঝাঁকুনি বেশ ভালোই লাগছিল আমাদের। জনবিরল এ অঞ্চলে অল্প কিছু পর্যটক ও আর্মি জিপ ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ল না।
আমাদের গাড়িটি ক্রমেই সমতল ভূমি থেকে পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠছে খাদের একদম কিনারা ঘেঁষে। গাড়ির চাকা ইঞ্চিখানেক এদিক–ওদিক হলেই একদম গভীর খাদে! পাহাড়ের সর্পিল বাঁক বেয়ে গাড়িটি উঠছে তো উঠছেই। ভয়ে সত্যি গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার পাশে বসেছে ছোট বোন সুমি, তার পাশে বড় খালা মুক্তি, পেছনে ছোট খালা তৃপ্তি। চালকের পাশে ছোট খালু। সব পথ আমার দুই খালা প্রায় চোখ বন্ধ করে ভয়ে সিঁটিয়ে রইলেন।
মুক্তি খালা উর্দু বাংলা মিশিয়ে আর্তনাদ করে উঠছেন কিছুক্ষণ পরপরই ‘আর কতদূর, যাব না আমি, আমায় নামিয়ে দাও’। বিকারহীন জিপচালক হিন্দি গান বাজিয়ে মৃদু মাথা নাড়তে নাড়তে গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিল। শাঁই শাঁই করে গাড়ি ছুটছে এঁকেবেঁকে। যেন রোলার কোস্টারে চড়েছি।
যতটুকু পারি আমরা উপভোগ করার চেষ্ট করছি দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পাহাড়, খরস্রোতা নদী, পাথর, অরন্য, খাদ—সব মিলিয়ে আশ্চর্য সুন্দর সব! আমাদের ভ্রমণ দলের বৈশিষ্ট্য হলো বেড়াতে গেলে চলতি পথে সমস্বরে গান ধরা। কদিন আগেই কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে ‘বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান...’, ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ...’ এমন কত সুর ছড়িয়ে দিয়ে এলাম।
অথচ আজ ভয়ে সবাই শক্ত হয়ে বসে আছে। গান তো দূরের কথা কেউ কথা বলে উঠলেই খালা সুরা পড়া বন্ধ করে কটকট করে তাকাচ্ছেন। জীবন মৃত্যুর রোমাঞ্চ নিয়ে আমি আর সুমি উপভোগ করছি গিরিপথের এই দুর্ধর্ষ ভ্রমণ।
যত ওপরে উঠছি পথ তত ভয়ংকর মনে হচ্ছে। আমার দুই খালা এর মধ্যে প্রায় অর্ধমূর্ছা হয়ে আছেন। পেছন থেকে ছোট খালা মিহি সুরে বিলাপ শুরু করেন ‘চালক গাড়ি থামাও , যাব না, আল্লাহ গো।’ সামনের সিটে বসা খালু ধমক দিলেন। আবার একটু বাঁক বা ঝাঁকি আবার মিহি কান্না, আবার খালুর ধমক। এই চলে সারা পথ। আমি পানির বোতল এগিয়ে দিতে গিয়ে একবার বকা খেলাম। আমরা দুই বোন হাসি চেপে রাখি।
অবশেষে দুর্গম পথ পেরিয়ে বেলা প্রায় ১১টায় পৌঁছালাম জজিলা জিরো পয়েন্টে। সকালের মেঘ কেটে তখন ঝকঝকে রোদ উঠেছে। উপত্যকা আর পাহাড়জুড়ে নানা বর্ণের নাম না–জানা ছোট–বড় গাছ। অরণ্যঘেরা পাহাড় আর পাহাড় গাঢ় নীল আকাশে হেলান দিয়ে আছে সম্রাজ্ঞীর মতন।
পাহাড়চূড়ায় শুভ্র বরফ মুকুট। সূর্যরশ্মিতে চিকমিক সেই বরফ কুচি যেন হাজার বাতির আতশবাজি জ্বেলেছে উপত্যকাজুড়ে। আমরা পথের ক্লান্তি, ভয় ভুলে যাই মুহূর্তে।
হাতে গোনা অল্পসংখ্যক পর্যটক দেখা গেল এই জিরো পয়েন্টে। চা, বিস্কুটের ছোট ছোট দোকান আছে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। কারগিলের এই সেই জিরো পয়েন্ট। বিশ্বের উচ্চতম এই গিরিশৃঙ্গে ঘটে যাওয়া কারগিল যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা দাঁড়িয়ে। ভাবতেই অন্য রকম লাগল।
নীল পানির খরস্রোতা সিরু নদী
জিরো পয়েন্টের ওপারে পাকিস্তানের অংশ—আজাদ কাশ্মীর (মুজাফফরবাদ), যা মাত্র ৭ কিমি দূরে। এপারে ভারতীয় অংশ জম্বু-কাশ্মীর। মাঝখানে নীল পানির খরস্রোতা সিরু নদী। সিরু একটি উপনদী যা কারগিলে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানের সিন্ধু নদে মিলিত হয়েছে। নদীটির দুই পাড়ে বিশাল বিশাল পাথরের স্তূপ, তাতে আছড়ে পড়ছে প্রমত্ত ঢেউ! নদী, আকাশ, পাহাড়–সীমানা দ্বন্দ্ব বোঝে না, বোঝে না বিভেদ। মানুষই কেবল দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে বিভাজন খোঁজে, বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই এত অস্ত্র, যুদ্ধ, রক্তক্ষয়।
জিরো পয়েন্টে আছে ঐতিহাসিক কারগিল যুদ্ধে মৃত সৈনিকদের স্মরণে মনুমেন্ট রয়েছে। আছে রঙিন টিনের চাল ছাওয়া আর্মি ক্যাম্প। পতপত করে উড়ছে ভারতীয় পতাকা। জলপাই রং ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি চারদিকে। এখানে প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকে। পরিবেশটা একটু থমথমে, গা–ছমছম ভাব আছে।
তবে থেমে নেই আমাদের ক্লান্তিহীন ফটোসেশন। প্রতিটা স্পট এত সুন্দর যে ইচ্ছে করে সব ধরে রাখি ছবি ফ্রেমে। দুপুরের রোদ ক্রমে ম্লান হয়। এবার আমাদের ফেরার পালা। আসন্ন সুর্যাস্তের কাছে, ধ্যানী পাহাড়পুঞ্জের কাছে, খরস্রোতা সুরা নদীর কাছে বিদায় নেই।
আবার সেই জজিলা পাস! বিপজ্জনক ভীতিকর পথচলা। এবার পাহাড় বেয়ে ক্রমেই নিচে নামছে গাড়ি। নামছে তো নামছেই। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে জিপটি এক্ষণি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখ থুবড়ে গড়িয়ে পড়বে। আমি দেখছি পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিকেলের সোনা মাখা রোদ। বিদায়!
আর গাড়িতে তখন দুই খালা কঠিন মুখে বসে আছেন। তাদের রাগানোর জন্য সুমি গুনগুন করে ‘এ পথ যদি না শেষ হয়...’। দোয়া–দরুদ বন্ধ করে খালা চিৎকার করে উঠে ‘গান থামাও, মরে যাচ্ছি, এখানে কেউ আসে...’। আমরা দুবোন কনুই দিয়ে গুঁতাগুঁতি করি, চোখে চোখে হাসি।
রুদ্ধশ্বাস তিন ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সমতলের দেখা মিলল। স্বস্তি ফিরে এল সবার মনে। এর মধ্যে সূর্য অস্ত গেছে মাত্র। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় থেকে যেন সুরু নদীটিও নেমে এসেছে। নদীর পাড় ঘেঁষে আমাদের গাড়িটি চলছে। আকাশে টুকরো মেঘ। জনমানবহীন লোকালয়ে খরস্রোতা সুরু নদীর উত্তাল কলকল শব্দ মাদকতা ছড়াচ্ছে প্রকৃতিতে, আমাদের মনে।
স্তব্ধতার রেশ নিয়ে রাত আমরা আটটার দিকে আমরা কারগিল শহরের সোনমার্গ পৌঁছাই। শ্রীনগরে আমাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা। ইচ্ছে করলে কেউ কারগিলের পর্যটন কেন্দ্রে থাকতে পারেন।
রাত বাড়ে। আমরা এগোই গন্তব্যের দিকে। পেছনে পরে থাকে মৌন পাহাড়, দুর্গম গিরিপথ, পাহাড়চূড়ায় বরফকুচি, সিরু নদির স্রোত, পাথরের স্তূপ আর বিমূর্ত সময়!
‘কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি
পাহাড় স্থাণু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই কিনতাম,
কারণ আমি ঠকতে চাই...
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে’
—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ভাবছিলাম এমন ভুস্বর্গে কেন দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ কেন রক্তক্ষয়! জয়ী হওয়ার বদলে মানুষ কেন নদীর মতন বিভেদহীন হতে পারে না, পারে না পাহাড়ের মতন উদার।
*লেখক: চিকিৎসক, সেগুনবাগিচা, ঢাকা