কাতারে সড়ক দুর্ঘটনায় তিন প্রবাসী তরুণের মৃত্যুতে শোকের ছায়া

ইসরান বিন ইসলাম, আজহরুল হক জয়, আহমেদ সাফওয়ান
 ছবি: সংগৃহীত

কাতারে তিন বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় কাতারের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক সালওয়া রোডে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত তরুণদের লাশ এখন হামাদ কেন্দ্রীয় হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।
দুর্ঘটনায় নিহত তরুণেরা হলেন আহমেদ সাফওয়ান (২০), ইসরান বিন ইসলাম (২১), আজহরুল হক জয় (২১)। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান ওই তিনজনের বন্ধু নাজিবুল হক (২১)। তাঁদের মধ্যে আহমেদ সাফওয়ান, ইসরান ও নাজিবুল হক মুগলিনা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। আজহারুল হক থাকতেন দোহা জাদিদ এলাকায়।
নাজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রায়ই ঘুরতে বের হই, গতকালও সেভাবে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। আমি, সাফওয়ান ও ইসরান ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। জয় আমাদের আরেক বন্ধু। আমরা জয়ের গাড়িতে ছিলাম। বিকেল পাঁচটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যখন আমরা সালওয়া রোডে, তখন গাড়ির চাকা বিকল হয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটায় তখন ছয়টার কিছুক্ষণ পর। এমনভাবে চাকা বিকল হয় যে গাড়িটি রাস্তার মাঝ লেন থেকে সরানো যাচ্ছিল না। আমি তখন গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে অন্য গাড়িগুলোকে ইশারা দিয়ে অন্য লেনে যেতে বলতে থাকি। বাকি তিনজন চাকা বদলানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎই দেখি, একটি গাড়ি দ্রুত বেগে আসছে ওই লেনেই।

আমি বুঝে যাই, এ গাড়ি থামতে পারবে না। আমি তখন অন্য লেনে চলে যাই। আর ওই গাড়ি আমার বন্ধুদের চাপা দিয়ে উল্টে যায়। রাস্তায় থাকা এক পুলিশ তখন অ্যাম্বুলেন্স ডাকে। হাসপাতালে যাওয়ার পর শুনি, আমার তিন বন্ধু আর নেই।’
আহমেদ সাফওয়ানের বাবার নাম ইকবাল আহমদ। সিলেট জেলার সদর থানার রাখালগঞ্জে তাঁদের বাড়ি। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে কাতারে বাস পরিবারটির। এ পরিবারের বড় ছেলে মারওয়ানও ৬ বছর আগে ২০১৬ সালে কাতারে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের পরিবারে একে একে দুই ছেলেকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় ইকবাল আহমদ।

ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি

আহমেদ সাফওয়ান কাতার এয়ারওয়েজে কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করতেন। আট মাস আগে তিনি সে কাজে যোগ দেন। আহমেদ সাফওয়ানের লাশ আজকালের মধ্যে কাতারে দাফন করা হবে।
ইসরান বিন ইসলামের বাবা নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, ‘আমার ছেলে এখন পোল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ২৭ মার্চ তার ফি পরিশোধের কথা ছিল।’

কাতারে ৩৪ বছর ধরে সপরিবার থাকছেন নুরুল ইসলাম। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানায় তাঁদের বাড়ি। তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ইসরান মেজ।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘গত শনিবার বেলা ১১টার দিকে ইসরান বিন ইসলামের সঙ্গে শেষ কথা হয় আমার। পরে রাতে দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর ইকবাল আহমদ আমাকে জানান, ওদের তিনজনের কেউই বেঁচে নেই। দুর্ঘটনায় ইসরান মাথায় আঘাত পেয়েছিল।’ ছেলের লাশ কাতারে দাফন করার ইচ্ছা জানালেন নুরুল ইসলাম।

আজহরুল হক জয়ের গাড়ি

যাঁর গাড়িতে করে ঘুরতে বের হয়েছিলেন এই তরুণেরা, তিনিও বেঁচে নেই। তাঁর নাম আজহারুল হক। তাঁর বাড়ি ফেনীর পরশুরাম থানায়। জয়ের বাবা ফজলুল হক ২২ বছর ধরে কাতারে থাকছেন। বাংলাদেশে স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ালেখা শেষে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন জয়। থাকতেন মা ও নানার সঙ্গে দোহা জাদিদ এলাকায়।
ফজলুল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে জানান, ‘২৮ মার্চ জয়ের জন্মদিন। গত রাতে (২৬ মার্চ) ছেলের লাশ মর্গে দেখে এলাম।’ জয়ের লাশ দেশে পাঠাতে আগ্রহী তাঁর পরিবার।

কাতারে এই মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর শোকাবহ পরিস্থিতির তৈরি হয় নিহত তরুণদের পরিবার ও পরিচিতজনদের মধ্যে। অনেকে ছুটে যান তাঁদের পরিবারে শোক ও সমবেদনা জানাতে।

বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন শ্রম কাউন্সেলর মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি দূতাবাসের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং লাশ দেশে পাঠানো ও স্থানীয়ভাবে দাফন করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যেকোনো সহায়তা ও সেবা দিতে দূতাবাস প্রস্তুত রয়েছে বলে তাঁদের জানান।