মানবজীবন আসলে হাজারো চমকে ভরা। সুন্দর অনাবিল এই জীবনে অনেক কিছুর দেখা মেলে। পা হারানো ছোট ফুফাতো ভাইকে পিঠে নিয়ে স্কুলে যাওয়া মামাতো ভাইকে দেখে মানুষের বেঁচে থাকার সুন্দর মুহূর্তগুলোরই কথাই মনে পড়ে। গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া পৌর সদরের চান্দের বাজার সেতুর পাশের ঘটনা মনে ভাবনার খোরাক জোগায়।
ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা একটা। চান্দের বাজার সেতুর কাছে আসতেই চোখ আটকে গেল স্কুলগামী কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখে। চোখ আটকে যাওয়ার কারণ তাদের খুনসুটি। একজনের পিঠে চড়ে আছে আরেকজন। ছোটবেলা বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের পিঠে চড়ে ঘুরতাম। হাতে থাকা ক্যামেরাও তাক করে ক্লিক করতে দেরি হলো না। কিন্তু ওরা যখন আরও কাছাকাছি এল, তখন রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। যে শিশুটি পিঠে, সেই শিশুর হাঁটু থেকে দুটি পা নেই...।
কথায় কথায় জানতে পারলাম ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পৌর সদর চান্দের বাজার এলাকার মাছ বিক্রেতা আবুল কাশেমের একমাত্র সন্তান পিঠে থাকা শিশুটি। তার নাম নাহিদ। জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী নাহিদ। তাকে চলতে-ফিরতে সাহায্য করে তার মা আর ফুফাতো ভাই আবু কাউসার। আবু কাউসার আবার নাহিদের অন্তরঙ্গ বন্ধুও।
কাউসার জন্মের পর থেকেই পারিবারিক সমস্যার কারণে মায়ের সঙ্গে থাকে মামাবাড়িতে। যেহেতু একসঙ্গেই বেড়ে ওঠা, তাই অদ্ভুত মধুর বন্ধুত্ব দুজনের মধ্যে। স্থানীয় চান্দের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে নাহিদ ও আবু কাউসার। প্রতিদিন নাহিদকে পিঠে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কাজটি করে আজন্ম হৃদয়ের বন্ধু-ভাই কাউসার।
কাউসার ও নাহিদ শুধু বন্ধু নয়। দুজনই পড়ে একই ক্লাসে। ঘুমও একই বিছানায়। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলে দুই বন্ধুর। প্রতিদিন বিকেলে কাউসার নাহিদকে পিঠে নিয়ে বাজারে ও আশপাশে ঘুরতেও বের হয়। টানা কয়েক ঘণ্টা পিঠে নিয়েও কোনো ক্লান্তি নেই কাউসারের।
খুব বোকার মতোই কাউসারকে বলেছিলাম, আচ্ছা নাহিদকে পিঠে নিয়ে যে এত সময় ঘুরে বেড়াও, কষ্ট হয় না। কাউসার বলে, ‘ছুডু থেইক্কা আমরা এক লগে, নাহিদরে ছাইড়া কোনোহানে যাইতে মন চায় না আমার। আমি ছাড়া অর খেলার সঙ্গী নাই। অর সাথে না খেললে ও রাগ করে।’
কাউসারের উত্তর শুনে কিছুক্ষণ ভেবেছি। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আসলে একেই বলে।
নাহিদের বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি কখনো মনে করি না আমার পোলার পাউ (পা) নাই। আমার পোলাডার মুহের দিকে চাইলে বুকটা জুড়াইয়া যায়। নাহিদরে স্কুলে ভর্তি করছি, টেকা-পয়সার হিসাবটা শিখতে পারলে চাইড্ডা ডাইল-ভাত খাইয়া চইলা যাব অর জীবন। আল্লায় অরে বাঁচায়া রাহুক...।’
তেমন কোনো বড় স্বপ্ন নেই নাহিদের। বড় হয়ে সে বাবার মাছের দোকানের হিসাব রাখবে। বাবাকে সাহায্য করবে, এটুকুই।
নাহিদ বলে, ‘আমার স্কুলে পড়তে ভালা লাগে, স্যাররা আমায় খুব আদর করে। আমি আরও লেহাপড়া করতে চাই।’
জীবন আদতে হাজারো চমকে ভরা। আবার জীবন কখনো সুন্দর অনাবিল। এদের স্বপ্ন এভাবেই বেঁচে থাক।