স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

কলেরাযোদ্ধা হয়ে দেশে দেশে চিকিৎসা দেন তাঁরা

১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০টি দেশে কলেরা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়িত চিকিৎসা দল পাঠিয়েছে আইসিডিডিআরবি।

ডায়রিয়াজনিত রোগ, বিশেষ করে কলেরা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া। বিশ্বের কোনো দেশ কলেরা নিয়ন্ত্রণে দিশেহারা হয়ে পড়লে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাক দেয় আইসিডিডিআরবিকে। আইসিডিডিআরবি দ্রুত বিশেষায়িত চিকিৎসা দল পাঠায় দেশটিতে। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০টি দেশে এই সহায়তা গেছে বাংলাদেশ থেকে। কোনো কোনো দেশে একাধিকবার দল পাঠানো হয়েছে।

ভূমিকম্প, বন্যা, খরা বা যুদ্ধের কারণে কোনো দেশে কলেরার প্রকোপ দেখা দিলে সেখানে যায় এই চিকিৎসা দল। বড় বড় শরণার্থীশিবিরে কলেরা দেখা দিলে ইউএনএইচসিআর ডাক দেয় আইসিডিডিআরবিকে। এখন যেমন তারা কাজ করছে দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শিবিরে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৬০ বছরে ডায়রিয়া তথা কলেরা নিয়ে গবেষণা, টিকা আবিষ্কার, ওআরএস উদ্ভাবনের পাশাপাশি এই রোগ চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছেন আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। রাজধানীর মহাখালীর কলেরা হাসপাতাল এবং চাঁদপুরের মতলবের ফিল্ড হাসপাতালে প্রতিবছর হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা দেন তাঁরা। এই দুই হাসপাতালের অভিজ্ঞতা এখন কলেরা চিকিৎসায় বিশ্বের কাজে লাগছে। কলেরা চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে আইসিডিডিআরবির এসব দল প্যান-আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনকে (সিডিসি) সহায়তা করেছে।

কলেরার ক্ষেত্রে আইসিডিডিআরবি এই কাজ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যে। গ্লোবাল আউটব্রেক এলার্ট অ্যান্ড রেসপন্স নেটওয়ার্ক (গোঅর্ন) নামের এই ব্যবস্থা ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিল আইসিডিডিআরবি। বিশ্বের ২৫০টি ইনস্টিটিউট ও নেটওয়ার্ক গোঅর্নের সদস্য। বিশ্বের কোথাও জনস্বাস্থ্যের তীব্র সংকট দেখা দিলে আক্রান্ত দেশে স্বাস্থ্য জনবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাঠানো হয়।

এ দেশের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা অন্য দেশের মানুষের সেবায় ব্যবহার করছেন। এটা অনেক বড় সম্মানের, অনেক বড় অর্জন।
আহমেদ মোস্তাক রাজা চৌধুরী, জনস্বাস্থ্যবিদ

১৯৯১ সালে পেরু দিয়ে শুরু

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে হঠাৎ কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কলেরা দ্রুত পেরুর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে কলেরা প্রতিবেশী দেশ ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এটা ছিল গত শতকের সবচেয়ে বড় কলেরা মহামারি। ওই মহামারিতে পেরুতে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৭০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর কলেরা দক্ষিণ আমেরিকার ১০টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রাজিল ও চিলি শুরু থেকে কলেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল। পারেনি পেরু ও ইকুয়েডর।

এই সময় যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির অনুরোধে আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা কলেরা নিয়ন্ত্রণে পেরু ও ইকুয়েডর সরকারের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।

এরপর থেকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন দেশে পরামর্শ ও দল পাঠিয়ে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখে আইসিডিডিআরবি। পেরু ও ইকুয়েডরের পর তারা সহায়তা দিয়েছে কঙ্গোর গোমা, তানজানিয়া, নেপাল, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, জিম্বাবুয়ে, হাইতি, পাকিস্তান, কেনিয়া, সোমালিয়া, সিয়েরা লিওন, ইরাক, সাউথ সুদান, মোজাম্বিক, সিরিয়া, ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনে।

এর মধ্যে তানজানিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন, কেনিয়া ও সোমালিয়ায় দুবার করে গেছে দলগুলো। ইরাকে ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট চারবার দল পাঠিয়েছে আইসিডিডিআরবি।

কলেরাযোদ্ধা

কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় ১০টি দেশে বিভিন্ন সময়ে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার দলে ছিলেন ডা. আজহারুল ইসলাম খান। অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আজহারুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওপর। কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকলে সেখান থেকে উদ্ধার করার পরিকল্পনাও করা থাকে।’ তিনি বলেন, যুদ্ধ চলার সময় মোট চারবার তাঁরা ইরাকে গিয়েছিলেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার সদস্যদের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা ছিল, একই ব্যবস্থা ছিল তাদের জন্য।

২০১০ সালে ভূমিকম্পের পর আফ্রিকার দেশ হাইতিতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যুর পর আইসিডিডিআরবির ১০ সদস্যের একটি দল হাইতিতে পৌঁছায়। ওই দলে ছিলেন চিকিৎসক, অণুজীববিজ্ঞানী, মেডিকেল অফিসার এবং দুজন নার্স।

এই বৈশ্বিক জরুরি দলটির সদস্য ডা. প্রদীপ কে বর্ধনের নেতৃত্বে হাইতির রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্স ও এর আশপাশের এলাকার হাসপাতালগুলোতে কলেরা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। মূলত তা ছিল প্রশিক্ষক তৈরির প্রশিক্ষণ। তীব্র ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে জরুরি চিকিৎসা কীভাবে দিতে হয়, তা ছিল প্রশিক্ষণের বিষয়।

অন্য একটি এলাকায় প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ডা. আজহারুল ইসলাম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীরা কেউ ইংরেজি জানতেন না। তাঁরা জানতেন ফরাসি। আমার ফরাসি ভাষা জানা ছিল না। কলেরা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার একটি ভিডিও চিত্র তাঁদের দেখানো হয়। তা অত্যন্ত কার্যকর ছিল। হাইতিতে এখনো সেই নির্বাক ভিডিও দেখানো হয়।’

‘ইউ আর অ্যানজেল’

ক্যাথরিন কস্তা আইসিডিডিআরবির মহাখালী কলেরা হাসপাতালে নার্সের কাজ শুরু করেন ২০০০ সালে। এখন তিনি নার্সিং অফিসার। নিজের পেশার প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একজন প্রায় পানিশূন্য কলেরার রোগীর শরীরে স্যালাইন দেওয়ার পর চোখের সামনে দেখতে পারি তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। এখানে পেশার সন্তুষ্টি আছে।’

দেশের এই অভিজ্ঞতা তিনি হাইতিতে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি বলেন, একটি হাসপাতালে কলেরায় মৃত দুই ব্যক্তির পাশে একজন প্রায় মৃত ব্যক্তিকে রাখা হয়েছিল। হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা জানতেন না পানিশূন্য ব্যক্তির শরীরে কী করে স্যালাইন দিতে হয়। ওই ব্যক্তির মৃত্যু হবেই ভেবে তাকে ওভাবে ফেলে রাখা হয়। এক প্রকার জোর করেই স্যালাইন দেন ক্যাথরিন কস্তা।

ক্যাথরিন কস্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকেই ওই ঘটনায় বিস্মিত হয়েছিল। আর ওই ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন “ইউ আর অ্যানজেল”।’

জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক আহমেদ মোস্তাক রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ নানা বিষয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। এ দেশের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা অন্য দেশের মানুষের সেবায় ব্যবহার করছেন। এটা অনেক বড় সম্মানের, অনেক বড় অর্জন।