একই ভিসা নিয়ে দুবার বাণিজ্যের সুযোগ।
পুনরায় নিয়োগকর্তার অনুমোদন (ওকালা) জটিলতা।
পুনরায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অপরাধ ছাড়পত্র নেওয়ার ব্যয়।
করোনা মহামারির জন্য বন্ধ হয়ে পড়া সৌদি আরবের শ্রমবাজার খুলেছে ছয় মাস পর। ভিসা ও টিকিট-জটিলতা কাটিয়ে ফিরতে শুরু করেছেন প্রবাসীরা। যদিও অনেকেই আছেন অনিশ্চয়তায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সৌদি যেতে ভিসা করানো নতুন কর্মীদের সংকট। তাঁদের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে আবেদন করতে হচ্ছে। এতে কর্মীদের ঘাড়ে চাপছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার বাড়তি খরচের বোঝা।
কুষ্টিয়ার মো. আশরাফুল রাজমিস্ত্রির কাজ করেন দেশে। সৌদি আরবে যাওয়ার ভিসা করান গত মার্চে। সুদের ওপর ধার নিয়ে টাকা দিয়েছেন। ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় যেতে পারেননি। এখন নতুন করে আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুলিশের ছাড়পত্র নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিদেশ না গিয়েই সাত মাস ধরে সুদ দিচ্ছি। গরিব মানুষ, এখন আবার টাকা কোথায় পাব?’
বাতিল হয়ে গেছে ৭০ হাজার নতুন কর্মীর ভিসা। ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা বাড়তি ব্যয় হবে প্রত্যেক কর্মীর।
বেসরকারি খাতে বিদেশে কর্মী পাঠানো এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার তথ্যমতে, আশরাফুলের মতো সংকটে পড়েছেন ৭০ হাজার কর্মী। তাঁদের সবার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন প্রথমে ঢাকার সৌদি দূতাবাসে ভিসা বাতিলের আবেদন করতে হবে। এরপর নতুন করে ভিসার জন্য সব কাগজপত্র জমা দিতে হবে। একই কাজে আবার টাকা খরচ করতে হচ্ছে সব কর্মীকে। এতে সব মিলে একজন কর্মীর নতুন করে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২৫ হাজার সৌদি ভিসা নতুন করে নিতে হবে। তবে এর সঙ্গে একমত নয় বায়রা। সংগঠনটির নেতারা বলছেন, ভিসা নিয়ে আটকে পড়া কর্মীদের তথ্য দিয়েছেন তাদের সদস্যরা। সব এজেন্সির তথ্য পাওয়া যায়নি। সব পেলে এটি লাখ ছাড়াতে পারে। বায়রার সদস্য হোপ হিউম্যান রিসোর্সেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০ কর্মীর ভিসা করা ছিল। এখন নতুন করে এগুলো আবার জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজধানী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. টিপু সুলতান বলেন, ৫০০ কর্মীর ভিসা আছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের। সবই নতুন করে করতে হচ্ছে।
ঢাকায় সৌদির ভিসা সেন্টার মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন বলছে, চাকরি করতে সৌদি যেতে হলে কর্মীর ভিসা প্রক্রিয়ার জন্য সৌদি আরবের কফিলের (নিয়োগকর্তা) কাছ থেকে অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির নামে ক্ষমতা প্রদানের সনদ (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) আনতে হয়। এটি ওকালা নামে পরিচিত। এরপর ঢাকায় অনুমোদিত কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ, স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে অপরাধবিষয়ক ছাড়পত্র এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। এরপর সব কাগজসহ সৌদি দূতাবাস অনুমোদিত ভিসা সেন্টারে জমা দিতে হয়। প্রাথমিকভাবে তিন মাসের পরিদর্শন (ভিজিট) ভিসা পান কর্মীরা। এর মধ্যে সৌদি আরবে পৌঁছে নিয়োগকর্তার মাধ্যমে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হয়।
এক লাখ কর্মীর কথা মাথায় রেখে ভর্তুকির চিন্তা করতে পারে সরকার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে ব্যয় কমানো যেতে পারে।শামীম আহমেদ চৌধুরী, মহাসচিব, বায়রা
বায়রা বলছে, করোনা পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের অর্থনীতিও সংকুচিত হয়েছে। তাই কোনো কোনো নিয়োগকর্তা কর্মী না-ও নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে খরচের পুরো টাকাই গচ্চা যাবে। আর যেসব নিয়োগকর্তা কর্মী নিতে চাইবেন, তাঁদের কর্মীর জন্য নতুন করে কফিলের কাছ থেকে ওকালা আনতে হবে। এটি জটিলতা ও ব্যয় বাড়াবে। আর দেশেও কয়েকটি সনদ নিতে হবে নতুন করে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে করোনার নমুনা পরীক্ষা। প্রতিটি ধাপে আগের মতোই আবার খরচ হবে, যা কর্মীকে বহন করতে হবে।
এ বিষয়ে বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এক লাখ কর্মীর কথা চিন্তা করে ভর্তুকির চিন্তা করতে পারে সরকার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে ব্যয় কমানো যেতে পারে।
প্রবাসী ও রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, সরকারিভাবে খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। একজন কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে কমপক্ষে সাড়ে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। একই ব্যক্তির আবার পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে এ ফি কমানো যেতে পারে। পুলিশের ছাড়পত্র নিতেও চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করেন কর্মীরা। আগের সনদ দেখে নতুন একটি সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উড়োজাহাজের টিকিটের দাম দুই থেকে তিন গুণ হয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিক দামে টিকিটের ব্যবস্থা করা দরকার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কম খরচে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে সরকার প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে পারে। আগের ওকালা দিয়ে ভিসা করানো গেলে জটিলতা অনেকটা কমবে।
এ বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত সৌদি সরকারের হাতে। দেশেও বিপদাপন্ন সব প্রবাসীর পাশে দাঁড়াতে বায়রাকে আজ (মঙ্গলবার) বিমএইটি থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সমিতি থেকে সুদে নেওয়া ঋণ ও ধারের টাকা দিয়ে সৌদি যাওয়ার ভিসা করিয়েছিলেন চাঁদপুরের ইব্রাহিম। সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ তাঁর। সাত মাস ধরে সুদের কিস্তি দিচ্ছে বেকার এ তরুণের পরিবার। এখন আবার খরচ করার মতো টাকা নেই তাদের কাছে।
এ বিষয়ে অভিবাসন খাতের বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে আগের ওকালা দিয়ে ভিসা করানোর বিষয়টি সমাধান করতে পারে। না হলে এটি নিয়ে নতুন করে বাণিজ্য হবে এবং ব্যয় চাপবে কর্মীর ঘাড়ে। আর কর্মীর ব্যয় কমাতে ওয়েজ ওনার্স বোর্ডের কল্যাণ তহবিল থেকে ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে।