গণপরিবহন চালুর পর থেকে রেলের কর্মীরাও মাঠে কাজ করছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনায় (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত লোকজনের অনেকেই বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ছে। এর ফলে কর্মচারীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং কর্মে অনীহা দেখা দিচ্ছে।
সম্প্রতি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এমন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তাদের দুটি হাসপাতালে কর্মীদের জন্য ৩০টি শয্যা বরাদ্দ চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, চিকিৎসার সুব্যবস্থার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে কর্মীদের ভয় কমবে, কাজে আগ্রহ তৈরি হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ১৪ জুন প্রথম চিঠি দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। একই চিঠি পুনরায় দেওয়া হয়েছে গতকাল বুধবার। চিঠিতে রেলের অনেক কর্মী করোনায় আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হলেও সংখ্যা বলা হয়নি। রেলওয়ে সূত্র বলছে, তারাও এখন পর্যন্ত প্রকৃত তথ্য পায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, রেলের শতাধিক কর্মী করোনায় আক্রান্ত। শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যাবে।
কমলাপুর জেনারেল হাসপাতাল রেলপথ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পরিচালনা করে। চট্টগ্রামের হাসপাতালটি রেলেরই অধীনে। তবে দুটি হাসপাতালেই করোনার চিকিৎসা হচ্ছে পুরোপুরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, কমলাপুর ও চট্টগ্রামে রেলের হাসপাতাল দুটিতে চিকিৎসক মোটামুটি আছেন। শয্যাও চাইলে বসানো যাবে। কিন্তু সংকটাপন্ন বা খুব খারাপ অবস্থায় থাকা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, হাসপাতালে কোনো আইসিইউ বেড নেই। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ বা ডায়ালাইসিস করারও ব্যবস্থা নেই। গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা যায় না। দীর্ঘদিন এই হাসপাতালগুলোতে মূলত আউটডোর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে ইনডোর চালু করা হয়েছে।
রেলের কর্মীদের জন্য শয্যা বরাদ্দ করা হলে রেল থেকে নতুন করে বিনিয়োগও করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রেলের টাকায় করোনা শনাক্তের পিসিআর মেশিন সংগ্রহ, ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে হাসপাতাল দুটির কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় প্রকল্প প্রস্তাব চেয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে রেলের হাসপাতাল দুটিতে করোনা শনাক্ত থেকে শুরু করে চিকিৎসার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করতে চাইছে রেল কর্তৃপক্ষ। আর এটা করার জন্যে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপক চাপও আছে কর্তৃপক্ষের ওপর।
রেলের কর্মীদের জন্য ৩০ শয্যা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যে চিঠি দেওয়া হয়, তাতে সই করেন রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এমঅ্যান্ডসিপি) এ কে এম আবদুল্লাহ আল বাকী। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রেলের কর্মীরা প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ ভালো হয়ে গেছেন। তবে বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এ জন্যই রেলের হাসপাতালগুলোতে রেলের কর্মীদের জন্য আলাদা শয্যা বরাদ্দ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
রেলে এখন পর্যন্ত কতজন আক্রান্ত হয়েছেন? জানতে চাইলে এই এডিজি বলেন, সঠিক সংখ্যাটা এখনো জানা যায়নি। তবে শতাধিক হবে।
রেলওয়ে হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু চিকিৎসক এবং শয্যার ব্যবস্থা করেছে। তবে আনুষঙ্গিক আরও সুবিধা বাড়াতে হবে। তারা এই বিষয়ে দুই হাসপাতালের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে (সিএমও) খরচের খাত দেখিয়ে একটা প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। এরপর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে সেগুলো কেনা হবে।
রেলের দুটি হাসপাতাল করোনা রোগীদের জন্য
কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালটি ২০১৫ সাল থেকে স্বাস্থ্য ও রেলপথ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পরিচালনা করছে। তবে করোনা পরিস্থিতির পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শাহজাহানপুর ও চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য চিহ্নিত করে।
দুটি হাসপাতালে ১০০ করে শয্যার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অধিকাংশ কক্ষই শূন্য, নেই শয্যা। কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল দুটি বরাদ্দ করার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কিছু শয্যা বসানো হয়েছে। পদায়ন করা হয়েছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। এখন কমলাপুর হাসপাতালে ৪০টি এবং চট্টগ্রামে ৫০ শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। চাইলে শয্যা আরও বাড়ানো যাবে।
কমলাপুর হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এখন ঠিকঠাক আছে। দরকার যন্ত্রপাতি, সুযোগ-সুবিধা।
এ দুটি হাসপাতালে আগে শুধু রেলের কর্মীদেরই চিকিৎসা দেওয়া হতো। এখন করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা পুরোটাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনামতো হচ্ছে। দুটি হাসপাতালে নতুন চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা উপাদান সরবরাহ করা হয়েছে।
শাহজাহানপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে করোনার ৫৭ জন রোগী ভর্তি হন। এর মধ্যে ৪৯ জন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। রোগীদের মধ্যে রেলের কর্মীর পরিবারের সদস্য দুজন। বাকিরা বাইরের রোগী।
এই বিষয়ে কমলাপুর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, শুরু থেকেই তাঁদের হাসপাতালে নানা সীমাবদ্ধ ছিল। এখন চিকিৎসকসহ কর্মী পাওয়া গেছে। তবে জরুরি রোগীদের সেবা দেওয়ার মতো সরঞ্জাম নেই। এর পরও এখন পর্যন্ত যেসব রোগী আসছেন, তাঁদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালের কোনো রোগী মারা যাননি। ৯০ শতাংশের কাছাকাছি রোগী সুস্থ্ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। সরকার যে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই তাঁরা চিকিৎসা দেবেন। তিনি বলেন, রেল কর্তৃপক্ষ ভেন্টিলেটরসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। তখন হয়তো জরুরি রোগীকেও চিকিৎসা দেওয়া যাবে।
আতঙ্ক থেকে আলাদা শয্যা চায় রেল
রেলওয়ে সূত্র জানায়, করোনায় রেলের কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, এর সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। এর কারণ, রেলে জটিল রোগী নেই বললেই চলে। তাই বেশির ভাগ রোগীই আক্রান্ত হওয়ার পর নিজেদের মতো করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সুস্থ্ হয়ে গেছেন অনেকেই। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী যৌথ পরিবার নিয়ে থাকেন। নিজে নন, আক্রান্ত হয়েছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।
রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও পেশাজীবী সংগঠন নিজেদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বরাদ্দ নিচ্ছে। অথচ রেলের নিজস্ব হাসপাতাল থাকার পরও এর ওপর নিজেদের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ নেই।
তিনি বলেন, প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। বাইরে গিয়েও চিকিৎসা পাওয়া যাবে না—এই আতঙ্ক থেকেই মূলত রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ তাদের দুটি হাসপাতালে নিজেদের জন্য শয্যা বরাদ্দ চাইছে। পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিরও দাবি তুলেছে তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেওয়া চিঠিতে যা আছে
গতকাল সর্বশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, গত ৩১ মে থেকে লকডাউন-পরবর্তী যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা শুরু হয়েছে। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে রেলের অনেক কর্মচারী সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। তাই তাঁদের প্রত্যহ যাত্রীদের সাহচর্যে যেতে হয়।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের বেশ কিছু কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত উক্ত কর্মচারীদের বিভিন্ন হাসপাতাল ভর্তি করতে নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ তাঁদের চিকিৎসা প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে।
আক্রান্ত কর্মচারীদের অনেকেই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে পরিবারের অন্য সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ছে। ফলে কর্মচারীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং কর্মে অনীহা দেখা দিচ্ছে।
এ অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার স্বার্থে রেলের কর্মচারীদের জন্য কোভিড-১৯-এর যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা বিশেষ প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে কমলাপুরে রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল এবং চট্টগ্রামে রেলওয়ে হাসপাতালে ১৫টি করে শয্যা রেলওয়ের করোনা আক্রান্ত কর্মচারীদের অনুকূলে রবাদ্দ রাখার বিশেষ অনুরোধ করা হলো।