কর্মচারী সমিতির ১৭৬ কোটি টাকা ‘আত্মসাৎ’

অধিকতর তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ সমবায় অধিদপ্তরের নিরীক্ষায়। ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থা নেয়নি।

  • ১৩৪ কোটি টাকা কমিশন দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। জমা দেখানো হয়েছে ২ কোটি টাকা।

  • ব্যাংক থেকে ৪৪ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, যার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।

ঢাকা ওয়াসা ভবন

ঢাকা ওয়াসার কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংস্থাটির কর্মচারী সমিতির ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় ওই সমিতির শীর্ষ পদে ছিলেন।

সমবায় অধিদপ্তরের এক বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ওপর এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে ২০২১ সালের জুন মাসে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সমবায় অধিদপ্তর ও ঢাকা ওয়াসাকে দেওয়া হয়। এতে আর্থিক অনিয়ম নিয়ে অধিকতর তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সমবায় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তারা নিরীক্ষা করেছে শুধু ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের। নথিপত্র ও হিসাব না দেওয়ায় বাকি সময়ের নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ফলে সমিতিতে আরও আর্থিক অনিয়ম হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।

এ অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান, পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেম ও সচিব শারমিন হক আমীরের মুঠোফোনে কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেকের মাধ্যমে গত ২৫ এপ্রিল লিখিতভাবে বক্তব্য চাইলেও জবাব দেয়নি ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সমিতির টাকা সরানো হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিরা ওয়াসা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ বলেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
শাহাব উদ্দিন, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক

নিরীক্ষায় যা এল

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির বিপুল আয়ের উৎস গ্রাহকের বিল থেকে পাওয়া কমিশন। ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা ওয়াসার সাতটি রাজস্ব অঞ্চলে গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায়ের কাজ করে। এর বিপরীতে তারা মোট বিলের ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে পেয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা কমিশন বাবদ প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়েছে। অথচ সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জমা দেখানো হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বাকি প্রায় ১৩২ কোটি টাকার কোনো হিসাব নিরীক্ষা দল পায়নি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সমিতির ব্যাংক হিসাব থেকে ৪৪ কোটি ২১ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এই টাকা হিসাব পাওয়া যায়নি।

ঢাকা ওয়াসার বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান ছিলেন কর্মচারী সমিতির বিগত কমিটির সভাপতি ও বিল আদায় কার্যক্রমের অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান। রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন ছিলেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আর অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক মিয়া মো. মিজানুর রহমান ছিলেন বিল আদায় কার্যক্রমের কো-চেয়ারম্যান।

অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘অনিয়মের যে অভিযোগ, তা আগের সভাপতির আমলের। বারবার আমাকে কেন প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় আমার জানা নেই। আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

অবশ্য মো. আক্তারুজ্জামান সভাপতির দায়িত্বে থাকার সময় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা দলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

নিরীক্ষায় অসহযোগিতা

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারীর নেতৃত্বে একটি দল নিরীক্ষা করে। নিরীক্ষার জন্য ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নোটিশ জারি করা হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে সমিতির তৎকালীন কমিটিকে চিঠি দেয় সমবায় অধিদপ্তর। তবে অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কমিটির কাছ থেকে নিরীক্ষা দল কোনো সহযোগিতা পায়নি।

এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরে টানাপোড়েনের পর ২০২০ সালে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির নির্বাচন হয়। নতুন কমিটি ওই বছর ২৯ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু বিগত কমিটি নতুন কমিটিকে সমিতির আয়-ব্যয়ের হিসাব বুঝিয়ে দেয়নি। নতুন কমিটির সদস্যরা বলছেন, আগের কমিটির কাছ থেকে হিসাব বুঝে না পাওয়ায় তাঁরা নিরীক্ষা দলকে হিসাব বিবরণী দিতে পারেননি। উল্লেখ্য, সমিতির নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে। আগের কমিটি এখনো আর্থিক ও সম্পদের হিসাব বুঝিয়ে দেয়নি।

সমবায় অধিদপ্তর জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে সমিতির আগের নিরীক্ষা প্রতিবেদন, ব্যাংক হিসাব বিবরণী, সাংগঠনিক নথিপত্র ও সমবায় অধিদপ্তরের নথি পর্যালোচনা করে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

‘জড়িতরা ওয়াসা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ’

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির বর্তমান কমিটির সদস্যরা বলছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না দিয়ে ঢাকা ওয়াসা সমিতির বর্তমান কমিটিকে চাপে রেখেছে। সমিতির নির্বাচনে করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার অভিযোগে শুধু নির্বাচিত ১০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা বিল আদায় কাজের চুক্তি নবায়ন না করলেও সমিতির ২৫টি গাড়ি ও ৬২ হাজার ৪৮১টি মিটার, জামানতসহ প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদ বুঝিয়ে দিচ্ছে না।

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সমিতির টাকা সরানো হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিরা ওয়াসা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ বলেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, রীতিমতো জুলুম করে ঢাকা ওয়াসা সমিতির সম্পদ দখল করে রেখেছে।