মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় সরকারিভাবে চাল সংগ্রহে চালকলমালিকদের কাছ থেকে খাদ্য অধিদপ্তর ও দলীয় নেতাদের ভিন্ন সিন্ডিকেট কেজিপ্রতি ছয় টাকা ভাগ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট ৫৭৭ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই চাল সংগ্রহে সরকারিভাবে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা দরে উপজেলার ১৪ চালকলমালিকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
মেসার্স খালেক রাইস মিলের মালিক আবদুল খালেক বলেন, এবার খাদ্য অধিদপ্তরে চাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয়। খাদ্য অধিদপ্তরসহ দলীয় প্রভাবশালী মহল কেজিপ্রতি তিন টাকা দাবি করছে। গত বছর খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আড়াই টাকা নিয়েছিলেন। এবার সেটি বেড়ে তিন টাকা দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া দলীয় লোকেরা কেজিপ্রতি আরও তিন টাকা দাবি করছেন। এ জন্য চাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিষ্ণুপদ পাল ও উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ খালেক গত সোমবার চাল সংগ্রহের উদ্বোধন করেন। চাল সংগ্রহে অনিয়ম হচ্ছে, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন গত মঙ্গলবার সাংসদ মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকনের মৌখিক নির্দেশে চাল ও গম ক্রয় বন্ধ রাখে খাদ্য অধিদপ্তর। তবে জেলা প্রশাসক আতাউল গনির নির্দেশে আবার চাল সংগ্রহ শুরু হয়।
সাংসদ সাহিদুজ্জামান বলেন, বিগত বছরগুলোতে মোটাদাগের একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। এবার তিনি চাল সংগ্রহে প্রথম থেকেই সিন্ডিকেটবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরাসরি চালকলমালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের জন্য তিনি নির্দেশ দেন, যাতে উপজেলার চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে চালকলমালিকেরা চাল তৈরি করে খাদ্য অধিদপ্তরকে দিতে পারেন। গত মঙ্গলবার একজন চালকলমালিক অটো রাইস মিল থেকে চাল কিনে গুদামে দিচ্ছিলেন, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি চাল সংগ্রহ বন্ধ করার নির্দেশ দেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান এম এখালেক বলেন, চাল সংগ্রহ বন্ধ করার মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিলেন সাংসদ। পরে আবার চাল সংগ্রহ চালু হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালকলমালিক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে চাল সংগ্রহে উপজেলাতে তিনটি সিন্ডিকেট সক্রিয়। একটি সরকারি খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং আরও দুটি স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। অটো রাইস মিল থেকে চাল কিনে গাড়ি ভাড়া করে গুদামে নিতে মোট ২৯ টাকা খরচ পড়ে যাচ্ছে। তার ওপর আবার ছয় টাকা করে সিন্ডিকেটকে দিতে হবে। এভাবে লোকসান করে কোনো চালকলমালিক চাল দিতে পারবেন না। এখন চালকলমালিকেরা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে জমাকৃত জামানত খোয়ানোর চিন্তায় রয়েছেন।
সিন্ডিকেটের বিষয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা খলিলুর রহমান বলেন, সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চাল সংগ্রহ চলছে। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কোনো প্রকার সিন্ডিকেট দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে না। চালের আর্দ্রতা ও মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চাল নেওয়া হচ্ছে।
>গাংনীতে চাল সংগ্রহ
উপজেলায় মোট ৫৭৭ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে
ইউএনও বিষ্ণুপদ পাল বলেন, এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রয়োজনে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অচল চালকল দেবে চাল
সরকারি পরিপত্রের নিয়মাবলিতে উল্লেখ আছে, চলমান চালকল, আলাদা চাতাল, বিদ্যুৎ-সংযোগ, ধান সেদ্ধ করার হাউস, বয়লার ও গুদামঘর থাকা সাপেক্ষে এসব চালকলের সঙ্গে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের এ চুক্তি করার কথা। অথচ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এমন ১৪টি মধ্যে ৯টি চালকলে বুধ ও বৃহস্পতিবার ঘুরে দেখা গেছে, তাদের চালকল অনেক আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জোড়পুকুরিয়ায় অবস্থিত রাজু রাইস মিল পাঁচ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বলে এর মালিক রাজু আহম্মেদ জানান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় পাঁচ বছর ধরে এটি চালাতে পারিনি। চালকলের নামে চাল বিক্রির লাইসেন্স রয়েছে। সে কারণে বাইরে থেকে চাল কিনে গুদামে বিক্রি করবেন। তিনি এবার ৩৯ মেট্রিক টন চাল দেওয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন।
জোড়পুকুরিয়ায় আলমাস হোসেনের রাইস মিলে চার বছর ধরে মাছের খাবার তৈরি করা হয়। ধান শোকানোর চাতালটি এখন মাছের খাবার শোকানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনিও এবার ৩৯ মেট্রিক টন চাল দেওয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন।
রাইপুর এলাকায় খালেক চালকলে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকায় ধান সেদ্ধ করার স্থানে ঘাস জন্মেছে। এলাকার কিষানিরা তাঁদের বাড়ির ধান শোকানোর জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছেন। ধান সেদ্ধ করার বয়লার নেই। চালকলটি গ্রামের একজনকে মাসিক চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এই চালকল এবার ২৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালকলমালিক প্রথম আলোকে বলেন, এবার তিনি ৪২ মেট্রিক টন চাল দেওয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে কেজিপ্রতি সরকারি কর্মকর্তা ও বাইরের সিন্ডিকেট মিলিয়ে ছয় টাকা ঘুষ দিতে হবে।
উপজেলা খাদ্যগুদামের ওসি-এলএসডি বলেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে চালকলমালিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। এ ধরনের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।