করোনা সংক্রমণের মধ্যেই বাড়ছে ডেঙ্গু

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

আবু জামিল ফয়সাল
  জনস্বাস্থ্যবিদ

করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। মূলত রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। গত ১১ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৮৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৯২ জন। এর মধ্যে গতকাল ৮১ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাদের ৮০ জনই ভর্তি ছিল রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। আর বাকি একজন রোগী ভর্তি ছিলেন ঢাকা জেলায়। চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যু হয়নি।

মশক নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতাও জরুরি।
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ

গত বুধবার শেষ হওয়া জুন মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ২৭১ জনের, যা চলতি বছরে মোট শনাক্তের ৬৯ শতাংশ। গত বছরের জুন মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ২০ জনের। সে হিসাবে গত বছরের জুন মাসের তুলনায় এবারের জুন মাসে রোগী বেড়েছে সাড়ে ১৩ গুণ। ২০২০ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জন।

সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই চার মাস মূল মৌসুম। কয়েক দিনের থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টি এডিস মশার বংশবিস্তারে প্রভাব ফেলছে। করোনা আর ডেঙ্গুর উপসর্গ কাছাকাছি হওয়ায় জ্বর হলে বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত বুধবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়েছে। কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে এবং কোথাও যেন স্বচ্ছ পানি না জমে থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান।

রাজধানীর তেজতুরী বাজারের বাসিন্দা ফয়সাল আজিমের স্ত্রী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন গত মঙ্গলবার। তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে মশার উপদ্রব বেশি হচ্ছে। অনেকেরই ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার কথা শুনছি। বাসার আশপাশ পরিষ্কার রাখার পরও ডেঙ্গু হয়ে গেছে।

২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এর আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ মানুষ প্রাণ হারায়। আর সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।

গত বছর ডেঙ্গুর এত প্রকোপ দেখা যায়নি। দুই সিটি করপোরেশন চিরুনি অভিযানসহ বেশ কিছু কার্যক্রম চালায়। এবার ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশের সিটি করপোরেশনগুলোকে নিয়ে একাধিক প্রস্তুতিমূলক সভা হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রতিদিন সকালে মশার লার্ভা মারার জন্য লার্ভিসাইডিং এবং বিকেলে উড়ন্ত মশার মারার জন্য অ্যাডাল্টিসাইডিং করছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, মশা নিধনে নিয়মিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে সেসব বাসার ৪০০ মিটার এলাকায় বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।

শুধু ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব না বলে মনে করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। গত সপ্তাহে বেশ কিছু এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে। নারী কাউন্সিলরদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করতে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ডেঙ্গু শনাক্তের সব ধরনের পরীক্ষার সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গুর মূল পরীক্ষা এনএস১ সর্বোচ্চ খরচ ৫০০ টাকা। পরিষ্কার পানি জমা হয়, এ রকম পাত্র, ফুলের টব, হাঁড়ি-পাতিল, চিপসের প্যাকেট বাড়ির আশপাশে না রাখতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। দু-তিন দিনের বেশি সময় যাতে কোথাও পানি জমে না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, মহামারি চলার সময় একটা দিকে বেশি খেয়াল থাকে, পাশ দিয়ে অনেক কিছু হয়ে যায়। করোনার মধ্যে ডেঙ্গুও এমন একটা বিষয়। মশক নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতাও জরুরি।