>করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেও লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে। গত চার দিনে দেখা যাচ্ছে, লঞ্চের যাত্রীদের কেউই ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে পারছেন না। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, লঞ্চগুলো হয়ে উঠছে করোনা সংক্রমণের বিস্তার কেন্দ্র। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসাদুজ্জামান।
প্রথম আলো: করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মনে লঞ্চের যাত্রীরা চলাচল করছে না? এ ব্যাপারে আপনারা কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?
গোলাম সাদেক: লঞ্চের সব যাত্রী স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে চলাচল করতে পারে, সে জন্য আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। এরপরও আমরা দেখছি, অনেক যাত্রী নিজেরা সচেতন নয়। তবে যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে যাতায়াত করে, সে জন্য আমাদের মনিটরিং টিম রয়েছে। সেই মনিটরিং টিম আরও জোরদার ভূমিকা পালন করবে। আমাদের উপস্থিতি আরও বাড়ানো হবে। লঞ্চগুলোতে একটা সিস্টেম যাতে তৈরি হয়, সে জন্য আমরা নিজেরা লঞ্চঘাটে কাজ করছি। আমিসহ আমার সিনিয়র অফিসাররা লঞ্চঘাটে উপস্থিত থেকে সিস্টেম গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। গত তিন দিনের অভিজ্ঞতা বলছে, দক্ষিণাঞ্চলের আমাদের যে শ্রেণির লোকজন লঞ্চের ডেক ব্যবহার করেন, তারা নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক কম। করোনা মহামারি যে একটা দুর্যোগ, এইটা তাদের কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। আমি মনে করি, সবাই মিলে যদি লঞ্চের যাত্রীদের বোঝানো যায়, তাহলে তারা নিজেরাই সচেতন হয়ে যাবে।
প্রথম আলো: অধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চলাচল করছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই। এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না?
গোলাম সাদেক: শত বছর ধরে লঞ্চে একটা নিয়ম চলে আসছে, সেটি হলো লঞ্চের যাত্রীরা সরাসরি লঞ্চে উঠে ডেকে অবস্থান নেয়। যার যার জায়গা দখল করে। পরে তারা টিকিট কাটে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। প্রথমে টিকিট না কেটে লঞ্চে ওঠার শত বছরের যে প্রথা রয়েছে, সেটা বদলের চেষ্টা চলছে। টিকিট কেটে লঞ্চের যাত্রীরা যাতে চলাচল করতে পারে, তেমন সিস্টেম খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা চালু করতে যাচ্ছি। লঞ্চমালিকেরা আমাদের কথা দিয়েছেন, তাঁরা লঞ্চের টিকিট বিক্রি করবেন। আমরা ঘাটে কাউন্টার করে দিচ্ছি।
প্রথম আলো: লঞ্চের বাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ একটি টেকনিক্যাল কমিটি করেছে। সেই কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে কি না?
গোলাম সাদেক: করোনার সংক্রমণ রোধে আমরা আমরা লঞ্চের যাত্রীসংখ্যা কিন্তু সীমিত করে দিয়েছি। সীমিতসংখ্যক যাত্রী নিয়ে কিন্তু লঞ্চমালিকেরা লঞ্চ চালাতে রাজি হয়েছেন। সীমিতসংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল করলেও তাঁরা কিন্তু এখনো ভাড়া বাড়াচ্ছেন না। লঞ্চের ভাড়া বাড়ানোর বিষয় নিয়ে আমাদের একটি টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। তারা বিষয়টি চেক করছে। ওই কমিটি দেখবে, আদৌ লঞ্চের ভাড়া বাড়ানো প্রয়োজন আছে কি না।
প্রথম আলো: করোনা সংক্রমণের মধ্যেও লঞ্চঘাটে হাজার হাজার যাত্রী ভিড় করছে। গাদাগাদি করে লঞ্চে চলাচল করছে। করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে আপনারা কী করছেন?
গোলাম সাদেক: সদরঘাটে বিকেলবেলা লঞ্চের অধিকসংখ্যক যাত্রী ভিড় করছে, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, সেটাও আমরা জানি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি। গত তিন দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে তিনটি পন্টুনে ভিড় বেশি হচ্ছে। যাত্রী চাপ বেশি। এখানে একটা শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার জন্য আমরা কাজ করছি। বিকেলবেলা শুধু হাতিয়ার চরাঞ্চলের লঞ্চের যাত্রীরা এই ভিড়টা করছেন। হাতিয়া অঞ্চলগুলো সড়কপথে যোগাযোগ নেই। সেখানে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম লঞ্চ। সেখানকার চরাঞ্চলের যারা মানুষ, তারা লঞ্চটাকে ব্যবহার করে। ঢাকার সদরঘাটের ৯, ১০ ও ১১ নম্বর পন্টুনে মূলত ভিড়গুলো বেশি লক্ষ করা যায়। লঞ্চের যাত্রীরা যাতে এভাবে ভিড় না করতে পারে, সে জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। বরিশাল, চাঁদপুর, ভোলা, পটুয়াখালী এলাকার লঞ্চগুলো একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আছে।
প্রথম আলো: প্রথম দুদিন জীবাণুমুক্তকরণ টানেল দিয়ে লঞ্চের যাত্রীরা প্রবেশ করেছে। কিন্তু দুটি জীবাণুমুক্তকরণ টানেল সচল নয়।
গোলাম সাদেক: ঢাকার সদরঘাটের লঞ্চঘাটে যাত্রীদের অনেক চাপ। আর জীবাণুমুক্তকরণ যে টানেল, তার তো একটা লিমিট আছে। যখনই জীবাণুমুক্তকরণ টানেল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের টেকনিক্যাল টিমের লোকজন ঠিক করার কাজ করছে। লঞ্চের যাত্রীরা যাতে জীবাণুমুক্তকরণ টানেলের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারে, সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। লঞ্চঘাটে ঢোকার প্রতিটি প্রবেশপথে জীবাণুমুক্তকরণ টানেল আছে। কিন্তু শুধু জীবাণুমুক্তকরণ টানেল দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব নয়। লঞ্চের যাত্রীরা গেট দিয়ে প্রবেশ করার পর লঞ্চের ভেতর যে জায়গায় তারা বসছে, সেসব জায়গায় জীবাণুমুক্ত করা জরুরি। আমরা দেখছি, লঞ্চের মালিকেরাও এগিয়ে এসেছেন। লঞ্চগুলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে লোকজনকে লঞ্চে প্রবেশ করাচ্ছেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে লঞ্চঘাটের চিত্র বদলে যাবে।
প্রথম আলো: জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, লঞ্চঘাটের করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সহায়তা নিতে পারে বিআইডব্লিউটিএ। এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো উদ্যোগ থাকবে কি না?
গোলাম সাদেক: আমরা বারবারই বলছি, করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ব্যক্তিগত সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। সদরঘাটে প্রতিদিন মাইকিং করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মাস্ক ছাড়া কেউ লঞ্চঘাটে প্রবেশ করবেন না। হ্যান্ড গ্লাভস পরবেন। নিজেরা সচেতন থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করবেন। আমাদের চেষ্টা রয়েছে। তবে আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সময়ে লঞ্চঘাটগুলোয় যদি কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করোনা সংক্রমণ রোধে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়, আমরা তাদের সাধুবাদ জানাব।
প্রথম আলো: নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, যাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মানবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গোলাম সাদেক: লঞ্চঘাটে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যারা নিয়ম মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণে অনেক লঞ্চকে জরিমানা করেছে বিআইডব্লিউটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। আমরা বারবারই লঞ্চের মালিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলছি, তাঁরা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী তোলেন। লঞ্চের কর্মচারীরাও যাত্রীদের বোঝাচ্ছেন, তাঁরা যেন নিয়ম মেনে চলেন। এরপরও অনেক লঞ্চ নিয়মকানুন মেনে চলছেন না। তখন আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। জরিমানা করছেন। শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে লঞ্চঘাটে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। জনসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় যদি লঞ্চব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষ, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ভীষণ অসুবিধায় পড়ে যাবে। আমাদের নিজেদের জীবন নিজেদের বাঁচাতে হবে।