দেশে একটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন (২০১২) আছে। রয়েছে দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি–২০১৯)। প্রাকৃতিক বা মানুষের সৃষ্ট কোনো ঘটনাকে ওই আইন ও আদেশে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা যায়। ওই ঘোষণার পর দুর্যোগ মোকাবিলার সব কাজ তত্ত্বাবধান করার কথা জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির। করোনা সংক্রমণের পর বৈশ্বিকভাবে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। সারা দেশকে করোনা সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ এলাকা করা হয়েছে লকডাউন। এ ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ওই দুই কমিটির সক্রিয় হওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি সভাও করেনি এ কমিটি।
এসওডি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে তাকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ধরনের দুর্যোগ হলে সরকারের ৪২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের আওতায় চলে যাবে। প্রধানমন্ত্রী ওই কমিটির সভাপতি ও সদস্যসচিব হচ্ছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এর সদস্যসচিব হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব।
দুর্যোগে সময়ে সরকারের প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ওই দুই উচ্চপর্যায়ের কমিটির আওতায় চলে আসার কথা। এসওডি অনুযায়ী, দুই কমিটির দেওয়া নির্দেশনা ও সুপারিশ মেনে এই সময়ের সব কাজ হওয়ার কথা। কমিটির সঙ্গে সরকারের ৪২টি মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, নাগরিক সংগঠনগুলোর কাজ সমন্বয়ের জন্য আছে আরও নয়টি জাতীয় পর্যায়ের কমিটি। আর স্থানীয় পর্যায়ের কাজ তদারকির জন্য আছে চারটি কমিটি। এসব কমিটি পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করেনি।
>দুর্যোগের সময়ে প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিটির আওতায় চলে আসার কথা। কিন্তু এবার তেমন দেখা যাচ্ছে না।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার বেশির ভাগ কাজই এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে গরিব মানুষদের খোলাবাজারে চাল দেওয়ার কাজ শুরু হলেও সেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেওয়ায় তা বন্ধ রয়েছে। ত্রাণ অধিদপ্তর থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ দেওয়া শুরু হয়েছে। আর ত্রাণ গ্রহণসহ করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা আসছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।
এ ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং এসওডি প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য আইনুন নিশাত মনে করেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার কাজে স্পষ্টত সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ছে। সামনের দিনে এ সমস্যা আরও জটিল হতে পারে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আসে, তখন বেশ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু সেখানে সরকারের প্রশাসনযন্ত্র, সামরিক বাহিনী, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় এনজিওগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে। ফলে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে হচ্ছে। এটি একটি ভালো মডেল। এখনো সময় আছে, করোনা পরিস্থিতিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ও এসওডি অনুসারে সরকারের সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় এনে আগানো উচিত।
লকডাউন আছে, আবার নেই
পুরো দেশ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে চলে যাওয়ায় দেশের বেশির ভাগ এলাকাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের একবার গ্রামের বাড়ি ফেরা। আরেকবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকায় আসা, পরদিন আবার বাড়ি ফেরার ঘটনা ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এরপর একে একে লক্ষ্মীপুর, বরগুনা ও সব শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জানাজায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঝুঁকিপূর্ণ জমায়েতগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে বাজার, মেলা, ত্রাণ সংগ্রহসহ নানা রকম জমায়েত হচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশে এর আগে সব বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করা হয়েছে মূলত এসওডি অনুসরণ করে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণী ও বড় বড় বন্যা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয় এসওডি অনুসরণ করেই। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই এসওডি তৈরি করেছে। বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশকে অনুসরণ করে এ ধরনের আদেশাবলি ও আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় তা পুরোপুরি কাজে লাগানো হচ্ছে না বলে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগবিষয়ক জাতীয় কাউন্সিল ও উপদেষ্টা কমিটি এখনো কোনো সভা না করলেও তাঁরা এসওডি অনুসরণ করেই কাজ করছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট চালের মজুত আছে এবং কোথাও কোনো সংকট নেই। সব জায়গায় প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কেউ বাড়তি চাইলে তা-ও দেওয়া হবে।
এর আগের দুর্যোগগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দেশি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে যুক্ত করা হয়েছিল। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে এবং বন্যার সময় স্কাউটদের কাজে লাগানো হয়। সাধারণত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে এদের কাজে সমন্বয় করা হতো।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনার মতো জাতীয় ও বৈশ্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বেশির ভাগ কাজ এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে করা হচ্ছে। এটা খুবই বিপজ্জনক। কারণ, এটি তাদের একার কাজ নয়, এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানোর কোনো অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা তাদের নেই। তাদের কাজের সঙ্গে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অধিদপ্তরের কাজের কোনো সমন্বয়ও দেখা যাচ্ছে না।
মাকসুদ কামাল বলেন, করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কীভাবে সামাল দেবে, তার কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সহযোগিতা করতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সহযোগিতা নিচ্ছে না। এখন জরুরি ভিত্তিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল ও উপদেষ্টা কমিটির সভা করে কাজগুলো সমন্বয় করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।