করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি থাকলে দূরশিক্ষণ বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।
আমার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া মেয়ের শ্রেণিশিক্ষক করোনা ছুটির শুরুতেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও ফেসবুক গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনলাইনেই পড়া দেওয়া, পড়া নেওয়াসহ শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক পরিবীক্ষণের একটি পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন এবং এসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অভিভাবকেরা ও শিক্ষার্থীরা বেশ সক্রিয়।
ধারণা করা যায়, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু দেশের সব এলাকায় বিশেষত মফস্বল বা গ্রামীণ জনপদের শিক্ষার্থীরা একইভাবে তথ্যপ্রযুক্তির এ সুযোগ নিতে পারছে কি না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ ধরনের পরিস্থিতিকে তথ্যপ্রযুক্তির পরিভাষায় ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ নামে অভিহিত করা হয়।
করোনাযুদ্ধে সফল দক্ষিণ কোরিয়া সরকার কর্তৃক প্রকাশিত Flattening the curve on COVID-1: How Korea responded to a pandemic using ICT শীর্ষক ডকুমেন্টটিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা মাত্র ২০ দিনে কীভাবে করোনা সংক্রমণকে আয়ত্তে এনেছে এবং এ ক্রান্তিকালে কীভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক সেবা অব্যাহত রেখেছে, তার বিস্তারিত তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেছে, যা অন্যান্য দেশের নীতি নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। প্রকাশনাটিতে শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত ব্যবস্থার মধ্যে দূরশিক্ষা (Remote Education) ব্যবস্থার প্রচলনের জন্য পর্যাপ্ত ডিজিটাল কনটেন্টের সহজলভ্যতা, বিনা মূল্যে হার্ডওয়্যার ও ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার মতো নীতি ছিল অন্যতম।
কয়েক বছর আগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি) হিসেবে কাজের সুবাদে জেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের Access to Information (A2I) প্রোগ্রাম এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় অনলাইন কনটেন্ট তৈরির ওপর প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এ প্রশিক্ষণ পর্যায়ক্রমে সারা দেশের সব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্কুল-কলেজগুলোতে কম্পিউটার সরঞ্জাম সরবরাহ ল্যাব তৈরি করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি ইতিপূর্বে বিতরণকৃত এসব হার্ডওয়্যার ও সফটওয়ার কতটুকু কাজ করছে বা কীভাবে এসব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়, সে সম্পর্কে বিশেষভাবে নির্দেশনার পাশাপাশি কোরিয়ার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে নিম্নলিখিত বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
হার্ডওয়্যার বিতরণ
দূরশিক্ষণ পদ্ধতি চালুর একটি পূর্বশর্ত হলো সব শিক্ষার্থীর কাছে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিংবা নিদেনপক্ষে একটি স্মার্টফোন থাকা। কিন্তু সব পরিবারে মোবাইল ফোন থাকলেও অডিও-ভিডিও কনটেন্ট ব্যবহারের উপযোগী স্মার্ট প্রকৃতির নয়। এমন বাস্তবতায় সবার কাছে স্মার্টফোন বা ট্যাবের মতো ডিভাইস পৌঁছানোর কাজটি চ্যালেঞ্জিং এবং সময়সাপেক্ষ। দক্ষিণ কোরিয়া এ সময়ে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান স্যামসাং ও এলজির সহায়তায় দরিদ্র পরিবারের মধ্যে ৩৬ হাজার ট্যাব বিতরণ করেছে বলে প্রকাশনায় উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় এ ধরনের উদ্যোগে (ট্যাব বা স্মার্টফোন বিতরণ) শামিল করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা যেতে পারে।
শিক্ষাসহায়ক সাইটে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা
মোবাইল অপারেটরদের সহযোগিতায় শিক্ষক বাতায়ন, সংসদ বাংলাদেশ টিভিসহ শিক্ষাসহায়ক সাইটগুলোতে কনটেন্ট দেখা ও ডাউনলোডের জন্য করোনা দুর্যোগের সময়ে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
শিক্ষক বাতায়ন (www.teachers.gov.bd): এটুআইয়ের সহযোগিতায় তৈরি এ বাতায়নে ৪ লাখ ২১ হাজার ১৩৪ জন শিক্ষক সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন এবং আড়াই লাখের বেশি কনটেন্ট আপলোড করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ করে বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে ডেভেলপকৃত এসব কনটেন্ট বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। এসব সহজলভ্য কনটেন্টের বিষয়টি ব্যাপক প্রচার করা যেতে পারে।
সংসদ টেলিভিশন (Sagshad Bangladesh TV): ইতিমধ্যে সব শ্রেণির পাঠক্রমের ক্লাস অনলাইনে সম্প্রচার শুরু করেছে। বর্তমানে এর একেকটি সেশনের ব্যাপ্তি মাত্র ২০ মিনিট। এর সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে। একই সঙ্গে এর একটি অফিশিয়াল ইউটিউব সাইটও চালু করা দরকার, যাতে কেউ টিভির ক্লাস দেখতে না পারলে পরবর্তী সময়ে এই সাইট থেকে ডাউনলোড করে বা অনলাইনে ক্লাসগুলো দেখতে পারে।
এফএম রেডিও: সংসদ টেলিভিশনের সেশনসমূহ রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
এসএমএস: কোনো শিক্ষার্থী বা অভিভাবক শ্রেণি অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন করলে বিনা মূল্যে প্রতিদিন সকালে শ্রেণির বিভিন্ন সেশন ও কনটেন্টের বিবরণ এসএমএসের মাধ্যমে প্রেরণ করা যেতে পারে।
শিক্ষা কর্মকর্তাদের সক্রিয়করণ: জেলা ও উপজেলায় কর্মরত শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে আরও সক্রিয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা। মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তরে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও কর্মমূল্যায়ন সূচক তৈরি করে তাদের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক তদারকির ব্যবস্থা করা।
* লেখক: পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ahmed_ullah2001@yahoo.com