আমার করোনা নেগেটিভ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

হয়তো নিজের চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাসই করতাম না! ফেসবুকে, গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখতাম করোনার ভয়াবহতার কথা, মানুষের কষ্টের নানা গল্প উঠে আসত তাতে। কীভাবে মানুষ দিনের পর দিন লড়ে যাচ্ছে, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সে কী চেষ্টা—এসব কিছুর ভয়াবহতা আঁচ করা যেত না, যদি না নিজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতাম।

ব্যক্তিগত বিশেষ একটা কাজে ঢাকায় যেতে হয়েছিল। না গিয়ে থাকতে পারলে অবশ্যই যেতাম না। আরও একটি নতুন মাসের প্রথম প্রহর, বাসা থেকে ফজরের নামাজ পড়ে ঢাকার উদ্দেশে বের হই। ডাবল মাস্ক, হাতে গ্লাভস, মাথায় ক্যাপ, ফুলহাতা শার্ট, আর পকেটে স্যানিটাইজার—এ নিয়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া বিধিমালা মোতাবেক, নিয়ম মেনেই বাসে উঠে একক সিটে বসি। বরাবর ওপাশের সিটে দুজন যাত্রী বসেছেন পাশাপাশি, যাঁদের মুখে মাস্কও নেই বা পুরো পথে তাঁরা কেউই স্যানিটাইজার ব্যবহার করেননি! দেখে আশ্চর্য হলাম, কিন্তু এ আর নতুন কী? আমরা বরাবরই উদাসীন থাকি।

ঢাকা যাওয়ার পথে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পার হওয়ার সময় এক বন্ধু ফোন দিয়ে খবর দিল, অন্য আরেক বন্ধুর বাবা সকালে ঢাকা মেডিকেলে হৃদ্‌যন্ত্রের প্রদাহজনিত কারণে মারা গেছেন। লকডাউনের আগে থেকেই রোগে ভুগছিলেন তিনি। ঢাকা পৌঁছে, বাসায় গিয়ে কাপড় বদল করে হাত-মুখ ধুয়ে, নতুন মাস্ক পরে নিলাম। রিকশায় করে আসার সময় কিনে নিলাম একটা ফেস শিল্ড, সেটাও পরলাম, হাতে গ্লাভস, আর পকেটে বোতল ভর্তি স্যানিটাইজার। রিকশা থেকে নেমে, রিকশায় উঠে, ভাড়া দিতে, কিংবা ভাংতি টাকা ফেরত নেওয়ার পরে স্যানিটাইজার দিয়ে নিজেও হাত পরিষ্কার করলাম, অন্যদেরও দিলাম। হাসপাতালের মূল ফটকে ছিল এক অন্য রকম দৃশ্য। কিছুক্ষণ পরপরই একটা করে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে আর আরেকটা বের হচ্ছে।

ঢামেকের নতুন ভবনের বন্ধুর বাবার বেড। এলিভেটর থাকলেও সেটাতে না চড়ে সিঁড়ি ভাঙলাম। সুনসান নীরবতা প্রতিটা ইউনিটের সামনের ফ্লোরে। গত বছর ডেঙ্গুর সময় এক বন্ধুকে নিয়ে যখন গেলাম, তখনো এই স্থানগুলোতে ছিল উপচে পড়া রোগীর ভিড়। এবারের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। ভেতরে ওয়ার্ডে রোগীদের স্থান। যত পার হচ্ছি, ততই বুকের ভেতর ভয় জন্ম নিচ্ছে। একটি বেডে একজন রোগী, তার আশপাশে চার-পাঁচজন করে মানুষ। কেউ রোগীর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন, কেউবা রোগীকে সোজা করে বসিয়ে রেখে নিশ্বাস নিতে সাহায্য করছেন। কোনো কোনো বেডে রোগী জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন আর আশপাশের মানুষ নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।


ডাক্তারদের সমাজে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়, নচিকেতার ‘ও ডাক্তার’ গানটির কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু সেদিন, হাসপাতালের ওই করিডরে থাকাকালীন ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময়ে ডাক্তারদের দেখেছি একটা জীবনকে বাঁচাতে তাঁরা কীভাবে লড়ে যাচ্ছেন। ডাক্তারদের কিছুক্ষণ পরপরই এ–বেড ছেড়ে ও–বেডে দৌড় দিতে হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনেরা রিপোর্ট হাতে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছেন। বাতাসের অভাবে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, ছুটে গেলাম দক্ষিণ পাশে খোলা জানালার পাশে। সতর্ক থেকে ফেস শিল্ড খুলে মাস্কের ভেতর দিয়ে জোরে নিশ্বাস নিলাম কিছুক্ষণ। অথচ ডাক্তার, নার্স বা অন্য স্টাফদের আপাদমস্তক পিপিই। তাঁদেরও তো অস্বস্তি লাগে!


আমার বন্ধুরা লাশ ডিসচার্জ করার চেষ্টা করছিল। আমি কোথাও না গিয়ে করিডরে রোগী দেখছিলাম। নিশ্বাস না নিতে পারার যে যন্ত্রণা, সেটা একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছিলাম সেদিন। কী দুঃসহ যন্ত্রণায় থাকেন এক একজন রোগী, তা বর্ণনাতীত। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে লাশ ধৌতকরণ ও তার পরবর্তী কাজের জন্য গেলাম মোহাম্মদপুরে। রাস্তায় তখন গাড়ি চলছে বেশ। গণপরিবহনে মানুষ তুলছে বাসের হেল্পাররা, ওঠানোর সময় যাত্রীদের হাতে স্প্রে করছেন তাঁরা, ডিসইনফেকশনের জন্য।

কাজ শেষে বন্ধু ও তার পরিবারকে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে আমরা অন্যরা সবাই বাসায় চলে গেলাম। মুঠোফোনে কিছুক্ষণ পরপরই যোগাযোগ হচ্ছে সবার সঙ্গে। বাসায় এসে গরম পানির ভাপ নিলাম, গরম পানিতে কুলকুচি করলাম, গোসলও সারলাম গরম পানিতে। রাত কাটালাম ভয়ে ভয়ে; বাসার আশপাশ সব সময় মুখর থাকত, নিচের গলিটা বাচ্চাদের খেলার আওয়াজে মেতে থাকত। কিন্তু এখন সেটা নীরব, নিস্তব্ধ।

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

পরদিন সকালে প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে চলে গেলাম প্রাণের ক্যাম্পাসে। ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণে’র সামনেই বসানো হয়েছে ব্যারিকেড, জহুরুল হক হলের সামনেও রয়েছে বাধা। রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের দিকে ঢুকে যাওয়া রাস্তার একটু আগেই দুটো ময়লার ভাগাড় পড়ে আছে। কাকেরা বসে কা কা করছে। অনেক দিন পর ক্যাম্পাসে কাকের আওয়াজ শুনলাম, আহমদ ছফা তাঁর ‘পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণে’ ঢাকা শহরের কাকদের নিয়ে লিখেছেন। ভিসি চত্বরে একটি কুকুর গা এলিয়ে শুয়ে আছে, গরমে ক্লান্ত না হলেও, ক্যাম্পাসের নীরবতায় সে ক্লান্ত ভীষণ। দুজন পুলিশের কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর বাসভবনের ফটকে। কলাভবনের নতুন গেটটি বন্ধ; দূর থেকে দেখলাম ‘অপরাজেয় বাংলা’ তার শাশ্বত গৌরবান্বিত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোকেয়া হল গেটে বসানো ছিল আরও একটি ব্যারিকেড। টিএসসির বাইরে মোড়গুলো বিক্ষিপ্ত মানুষের পদচারণে ছিল একটু মুখরিত। কিছু গাড়ি শাহবাগের দিক থেকে এসে দোয়েল চত্বর অভিমুখে যাচ্ছে, আর কিছু শাহবাগের দিকেই যাচ্ছে। হাতের বাঁ পাশে হাঁটলেই শাহবাগ। জাতীয় কবির কবরের শুভ্র সাদা রংটা কিছুটা বিবর্ণ দেখাল। কবি নিশ্চয়ই এ নিয়ে দ্রোহ করবেন না!


চারুকলার গেটও বন্ধ। বকুলতলায় ঘাস জন্মেছে, বেশ বড় হয়েছে। সামনে না গিয়ে আবার ফিরে গেলাম বাসায়। নিয়ম মেনে আবারও বাসে চড়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশে। নিস্তব্ধতায় ঘেরা উৎসবমুখর ক্যাম্পাসকে এমন নিথর, নিস্তব্ধ দেখে বুকের ভেতর হু হু করে কেঁদে উঠল। মনে হচ্ছিল যেন, মর্গে একটা লাশ পড়ে আছে!

রাতে বাড়ি পৌঁছে নিজের সঙ্গে বহনকৃত সব জিনিসকে ব্লিচিংয়ের পানি দিয়ে স্প্রে করলাম। পরনের জামা–কাপড় গরম পানিতে ধৌত করলাম। সবার থেকে আলাদা আছি। রাতে এক বন্ধু ফোন দিয়ে জানাল, আমাদের বন্ধুর বাবার লাশ দাফনের পর খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন আসে তদন্তের জন্য। করোনার রিপোর্ট চাচ্ছে ওরা। ভয় পেয়ে গেলাম, গলাও শুকিয়ে গেল। রিপোর্ট যদি পজিটিভ আসে, তাহলে আমাদের সবাইকে পরিবার–পরিজনসহ আইসোলেশনে যেতে হবে। বহু ঝামেলায় পড়তে হবে। এ ভেবে রাতে ঘুমও আসেনি। পরদিন সকালে রিপোর্টের জন্য গিয়েছিল বন্ধুর পরিবারের সদস্যদের একজন। সবাইকে ফোন করে জানাল, ‘করোনা নেগেটিভ’। পাশের বেডের একজন রোগীরও নেগেটিভ আসছে জানাল। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা। একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন শুধু নিয়ম মেনে পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে, আর হোম কোয়ারেন্টিনসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে নিয়মিত।

* শিক্ষার্থী, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। nac.arnobdu24@gmail.com