গত কয়েক সপ্তাহে ‘করোনা’ বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। চীনের পর এ ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত ইউরোপের দেশগুলো। দিনকে দিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ১৭ মার্চ রাত ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত জাতিসংঘভুক্ত ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৬৩টি দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। এই সময়ে মোট আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৮৩৭ জন। মারা গেছে ৭ হাজার ৫০০ জন (সূত্র: https://www.worldometers.info/coronavirus/)।
এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। কারণ, আমাদের মতো অনেক দেশ আছে, যেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধার অভাবে আসলেই কতজন আক্রান্ত তা জানা প্রায় অসম্ভব। তাই আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১০ জন—এটা ভেবে খুব খুশি হওয়ার কারণ নেই। এ ধরনের সংকটে পুরো সরকারকেই তা মোকাবিলা করার জন্য সব মন্ত্রণালয়, শাখা-প্রশাখাসহ একযোগে তৎপর হতে হবে।
করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকারকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে নাগরিক হিসেবে আমাদের ও অনেক কিছু করার আছে। নিজের দেশকে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ব্যক্তিপর্যায়ে আমাদের নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হবে:
১.
প্রথমত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিজে আতঙ্কিত হবেন না, অন্যদের আতঙ্কিত করবেন না। অন্যরা আতঙ্কিত হয়, এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড করবেন না। করোনায় আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে কখনোই যাবেন না। নিজে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। কী কী করতে হবে, তা ইতিমধ্যে আমরা সবাই জানি। আর পুনরাবৃত্তি করছি না।
২.
প্রবাসী যাঁরা দেশে এসেছেন, তাঁরা দয়া করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করুন। আপনাকে যদি হোম কোয়ারেন্টিনে (বাসার ভেতরে একা থাকা, কারও কাছাকাছি না আসা, ইত্যাদি) থাকতে বলা হয়, তাহলে আপনার নিজের, মা–বাবা, সন্তানের, পরিবার-পরিজনের, সর্বোপরি দেশের স্বার্থে তা কঠোরভাবে পালন করুন। খামখেয়ালি আচরণ করে এদের সবার জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন না। দুই সপ্তাহ বাড়ির বাইরে না গেলে আপনি–আমি মরে যাব না। কিন্তু এর অন্যথা হলে আপনি–আমি নিজেও মরব এবং পরিবার-পরিজন সবাইকে মারব।
৩.
জনসমাগমস্থল (বাজার-রেস্টুরেন্ট-উপসনালয়-জনসভা ইত্যাদি) যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। ধর্মীয় আচার-আচরণ নিজের বাড়িতে পালন করুন। অনেক ইসলামি রাষ্ট্র ও কিন্তু এখন মানুষকে মসজিদে যেতে নিষেধ করছে। কাবা শরিফের ছবিটা দেখুন। যেখানে মানুষের জন্য দিনরাত ২৪ ঘণ্টার কোনো সময়ই ঠিকমতো হাঁটা যেত না, সেখানে কর্তৃপক্ষ এখন মানুষের প্রবেশ সীমিত করে দিয়েছে। মন্দির-গির্জা ইত্যাদিতে যেতে ও মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
৪.
মনে রাখবেন, এটা বেড়ানোর সময় নয়, মজা করার সময় নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে করোনার সংক্রমণ এড়ানোর জন্য, আপনাদের ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য নয়। তাই খুব প্রয়োজন না হলে দরকারি কাজেও কোথাও যাবেন না। এখন ঘুরতে যাওয়া রীতিমতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের শামিল। কারও বাসায় দাওয়াত খেতে যাওয়ার অথবা কাউকে নিজের বাসায় দাওয়াত করার ও দরকার নেই। বাড়ির বাইরে বের হতে হলে সবার কাছ থেকে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।
৫.
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা করোনার সতর্কতার বিধিবিধানগুলো কঠোরভাবে মেনে চলুন। আপনারা নিয়ম মানলে অন্যরা মানতে উৎসাহিত হবেন, আপনারা না মানলে অন্যরা মানবেন না। আপনারা সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করার কার্যক্রম গ্রহণ করুন। তবে অবশ্যই নিজেকে সুরক্ষিত করে।
৬.
ঘরের দরজা-জানালা-গ্রিল দিয়ে অথবা বাইরে যেখানে–সেখানে থুতু ফেলবেন না। থুথু না ফেললে কিছু হয় না। উন্নত দেশে মানুষ কিন্তু বাইরে থুতু ফেলে না। খোলা মুখে হাঁচি-কাশি দেবেন না। বয়স্ক ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন, বিশেষ করে যাঁরা শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাই তাঁদের যত্ন বিশেষভাবে নিতে হবে।
৭.
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন, ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ ফল খান। ব্যায়াম করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে করোনাভাইরাস খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না।
মনে রাখতে হবে, উন্নত বিশ্বে মানুষের সংখ্যা অনেক কম ও অনেক সুযোগ–সুবিধা থাকার পরও তারা কিন্তু অনেক সতর্ক অবস্থায় আছে। তারা করোনাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। তাই আমাদের এই জনবহুল ও সুযোগ-সুবিধার অনেক অপ্রতুল দেশে আমাদেরকে উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই একমাত্র আমরা এই মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে সফল হলেও হতে পারি।
*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। ksfarid@gmail.com/ksfarid@bau.edu.bd