আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের সময়সীমা কমছে। আইসোলেশন শেষে করোনা পরীক্ষা না করার সুপারিশ।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কোভিড–১৯ চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোভিড–১৯ চিকিৎসাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকা হালনাগাদ করার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবর্তনগুলো শিগগির চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মূল পরিবর্তন আসবে আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্নকরণ এবং কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গনিরোধের ক্ষেত্রে। রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ওষুধ ব্যবহার করতে পারবেন চিকিৎসকেরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে করোনা চিকিৎসা নির্দেশিকায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান সিডিসির পরামর্শগুলোকে।
দুই বছর ধরে চলা মহামারির মধ্যে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে চিকিৎসকদের। কোভিড–১৯–এর উপসর্গ, রোগ শনাক্ত, রোগের স্থায়িত্ব, সংক্রমণের ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তনকে আমলে নিয়ে চলছে রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা। সর্বশেষ পরিবর্তন দেখা গেছে করোনার নতুন ধরন অমিক্রনের ক্ষেত্রে। অমিক্রন অতি দ্রুত ছড়ালেও এর উপসর্গ বা লক্ষণের তীব্রতা কম। তবে যাঁরা দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, হৃদ্রোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, কিডনির জটিলতা রয়েছে, তাঁদের কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গ তীব্র হতে দেখা যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি অনেক মানুষ পূর্ণ ডোজ টিকা নিয়েছেন, অনেকে বুস্টার ডোজ নিয়েছেন এবং আরও অনেকে দ্রুততম সময়ে টিকার আওতায় আসবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে পাঁচটি ওষুধ উদ্ভাবিত হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড–১৯ চিকিৎসায়। এসব কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধও কিছুটা শিথিল করার পক্ষে মত দিচ্ছেন চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গাইডলাইনের (কোভিড-১৯ চিকিৎসাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকা) নতুন সংস্করণ নিয়ে কাজ করছে। দু–এক দিনের মধ্যে তাঁরা তা জমা দেবেন। আশা করা যায়, আসছে সপ্তাহে তা চূড়ান্ত হবে।
আইসোলেশনের সময়কাল কমছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে ২০২০ সালের শুরুর দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ন্যাশনাল গাইডলাইন অব ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অব করোনাভাইরাস (কোভিড–১৯) তৈরি করেছিল। তাতে রোগ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিকে ১৪ দিন বিচ্ছিন্নকরণ অবস্থায় (আইসোলেশন) রাখার কথা বলা ছিল। একইভাবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকেও ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করার কথা ছিল। হাসপাতালে ও বাড়িতে রোগীর কী চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা হবে, তা–ও বিশদভাবে উল্লেখ আছে ওই নির্দেশিকায়।
এ পর্যন্ত নির্দেশিকাটির নবম সংস্করণ হয়েছে। দশম সংস্করণের কাজ চলছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ কাজের সঙ্গে জড়িত। সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। নির্দেশিকায় কী কী বিষয়ে পরিবর্তন আনা হবে, তা নিয়ে সর্বশেষ সভা হয়েছে ২৬ জানুয়ারি।
ওই কাজের সঙ্গে যুক্ত তিনজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিনের সময় সাত দিন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ সময়সীমা যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ দিন, ভারতে সাত দিন।
করোনা রোগীর আইসোলেশন ও নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও (আইইডিসিআর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লেখা ২৫ জানুয়ারির ওই চিঠিতে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেছেন, ‘নিশ্চিতভাবে নির্ণিত কোভিড-১৯ রোগীদের ১০ দিন আইসোলেশন শেষে ফলোআপ টেস্ট করার প্রয়োজনীয়তা নেই। যদিও অনেক ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ রোগীদের আইসোলেশন শেষে ফলোআপ টেস্ট করার প্রবণতা গোচরীভূত হচ্ছে।’
এর আগে কোভিড–১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ১৯ জানুয়ারি সভায় সুপারিশ করে যে কোভিড–১৯ রোগীর লক্ষণ প্রকাশের পর ১০ দিন পর্যন্ত আইশোলেশনে থাকবে।
আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিনের সময় যদি কমে আসে, তাহলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মক্ষেত্রে। অন্যদিকে পরীক্ষা যদি না করাতে হয়, তাহলে মানুষের অর্থের সাশ্রয় হবে। পরীক্ষা করানোর চাপও কমবে। তবে সময়সীমা ১০ দিন না ৭ দিন হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আইসোলেশন শেষে পরীক্ষার বিষয়েও কোনো সিন্ধান্ত হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এটি চূড়ান্ত করবেন। সিদ্ধান্ত শিগগির হবে।’
ওষুধের ব্যবহার
গাইডলাইন বা নির্দেশিকা হালনাগাদ করার কাজে যুক্ত দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, হালনাগাদ নির্দেশিকায় ওষুধের সঠিক ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোন ধরনের রোগী ওষুধ পাবেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে।
মহামারির শুরুতে কোভিড–১৯ চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ ছিল না। করোনা শনাক্ত হলেও রোগীকে সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি বা মাথাব্যথার অর্থাৎ লক্ষণভিত্তিক ওষুধ দেওয়া হতো। এখন করোনা নিরাময়ের সুনির্দিষ্ট ওষুধ আছে। এ পর্যন্ত কোভিড–১৯ রোগী চিকিৎসায় পাঁচটি ওষুধকে অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে চারটি ওষুধ বাংলাদেশে আছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, করোনা চিকিৎসার ওষুধ এখন বাজারে আছে। তবে ওষুধগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। সুনির্দিষ্ট লক্ষণ ছাড়া কোনো ওষুধ যেন ব্যবহার না করা হয়, সে ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে হালনাগাদ নির্দেশিকায়।
সিডিসির নির্দেশনা ও ভারতের অভিজ্ঞতা
রোগের ওপর নজরদারি করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান সিডিসি তাদের নির্দেশিকায় বলছে, টিকা দেওয়া থাকুক বা না থাকুক, পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হলে ওই ব্যক্তিকে পাঁচ দিন ঘরে থাকতে হবে বিচ্ছিন্ন হয়ে। কোনো উপসর্গ না থাকলে বা উপসর্গমুক্ত হলে পাঁচ দিন পর ঘরের বাইরে যেতে পারবেন। তবে বাইরে যাওয়ার সময় পরবর্তী পাঁচ দিন মাস্ক পরতে হবে।
কোয়ারেন্টিনের ব্যাপারে সিডিসি বলেছে, টিকার পাশাপাশি বুস্টার ডোজ নিয়েছেন, এমন কেউ কোভিড–১৯ আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে ১০ দিন মাস্ক পরে থাকতে হবে কারও সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলার সময়। এ পরিস্থিতিতে পাঁচ দিনের দিন করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। এ সময়ের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে পাঁচ দিন ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না এবং করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। অন্যদিকে যদি টিকার পূর্ণ ডোজ নেওয়া না থাকে এবং তখন কেউ কোভিড–১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে তাঁকে পাঁচ দিন ঘরে থাকতে হবে এবং তারপর ঘরের বাইরে গেলে পরবর্তী পাঁচ দিন মাস্ক পরতে হবে। কোভিড–১৯ আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পরও কেউ যদি ঘরে কোয়ারেন্টিনে থাকতে না পারেন, তাহলে তাঁকে ১০ দিন মাস্ক পরতে হবে।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় কোভিড–১৯ বিষয়ক তাদের নির্দেশিকা হালনাগাদ করেছে ৫ জানুয়ারি। তাতে বলা হয়েছে, শনাক্ত হয়ে সাত দিন ঘরে থাকার পর আইসোলেশনের মেয়াদ শেষ হবে। আইসোলেশন শেষ হওয়ার পরপর করোনা পরীক্ষার দরকার হবে না। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে কারও যদি উপসর্গ দেখা না দেয়, তাহলে করোনা পরীক্ষার দরকার নেই। তখন বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনা চিকিৎসাবিষয়ক হালনাগাদ দলিল দ্রুত চূড়ান্ত করা উচিত। পাশাপাশি দলিলে যেসব নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বা যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা দ্রুত চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী এবং মাঠপর্যায়ে যাঁরা মহামারি মোকাবিলার কাজে যুক্ত, তাঁদের জানিয়ে দেওয়া উচিত। যত দ্রুত মানুষকে জানানো হবে, তত তাড়াতাড়ি সুফল ঘরে আসবে।