>করোনা হলেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী নয়। করোনায় মৃত্যু কমাতে কারণ চিহ্নিত এবং তা দূর করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
সরকারি হিসাবে দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। এসব মৃত্যু ঠিক কোন পরিস্থিতিতে ঘটেছিল, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা কোনো মহল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় মৃত্যু কমাতে হলে অন্তত কিছু মৃত্যুর পর্যালোচনা হওয়া জরুরি।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১ হাজার ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সিংহভাগ মৃত্যু হাসপাতালে। প্রায় ২০০ মৃত্যু হয়েছে বাড়িতে ও রাস্তায়। এ ছাড়া করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ৯০০ মানুষ। অন্যদিকে আরও প্রায় সাড়ে নয় শ প্রবাসী বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মারা গেছেন। কোন পরিস্থিতিতে এসব মৃত্যু ঘটে চলেছে, তা মানুষ জানতে পারছে না।
উপসর্গ দেখা দেওয়ার কত পরে করোনা পরীক্ষা করা হয়েছিল, কত দিন বাড়িতে থাকার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, হাসপাতালে কী চিকিৎসা হয়েছে, কোন ধরনের ওষুধ তাঁকে সেবন করতে হয়েছিল, কবে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, কবে শ্বাসকষ্ট তীব্র হয়, কোন পরিস্থিতিতে অক্সিজেন দেওয়া হয়, কত দিন অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিল কি না, থাকলে কত দিন, একই সময় অন্য কোনো রোগ ছিল কি না, সেই রোগের চিকিৎসা কীভাবে হয়েছিল, মৃত্যুর সময় কী কী উপসর্গ ছিল—মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করার জন্য এ রকম আরও তথ্য দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। করোনা খুবই সংক্রামক হওয়ার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে যেতে পারেন না স্বজনেরা। অনেকে ভয় পান। অনেকের কাছে মৃত্যুর শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতিটা অজানা থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক আহমেদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, পর্যালোচনা করলে মৃত্যুর ধরন বা সাধারণ প্রবণতা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে। তা থেকে মানুষের কাছে সঠিক বার্তা দেওয়া যাবে। চিকিৎসায় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও এই তথ্য দরকার। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেছেন, ‘আপনি যদি মৃত্যু কমাতে চান বা মৃত্যু শূন্যতে নামিয়ে আনতে চান, তাহলে কারণ জানতে হবে। এসব কারণ অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৃত্যুর বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। রোগতাত্ত্বিক গবেষণার কাজ করে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তবে এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ পাওয়া যায়নি। একটি সূত্র বলছে, আইইডিসিআর শুরুর দিকে এ ধরনের একটি পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল। সেটি এখন বন্ধ আছে। তবে গত বছর আইইডিসিআর ডেঙ্গুতে সন্দেহভাজন আড়াই শর বেশি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করলেও তার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল এখনো প্রকাশ করতে পারেনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বা মৃত্যুর পর্যালোচনা অবশ্যই হওয়া দরকার, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হচ্ছে, এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ ধরনের পর্যালোচনা নীতিনির্ধারণ বা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় সহায়ক ভূমিকা রাখে।’ তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা আইইডিসিআরকে এ ব্যাপারে সক্রিয় করার করার জন্য তিনি ভূমিকা রাখবেন।
আইইডিসিআর বাংলাদেশে প্রথম করোনায় মৃত্যুর ঘোষণা দেয় হয় ১৮ মার্চ। একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করতে চায়নি। তবে গতকাল ওই হাসপাতাল জানিয়েছে, ওই ব্যক্তির বয়স ছিল ৭৪ বছর। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল আইইডিসিআর।
নতুন করোনাভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা প্রথম প্রকাশ পায় গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে সংক্রমণের প্রথম ঘটনা ঘটে। এরপর সংক্রমণ দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বাড়তে শুরু করে মৃত্যু। করোনায় মৃত্যু এখন বৈশ্বিক ও জাতীয়ভাবে প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে শুরু থেকে চীনের বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও গবেষকেরা মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। এ বছরের জানুয়ারির ২৪ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে এ বিষয়ে একাধিক গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এ। এখন সারা বিশ্বে এসব নিয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা হচ্ছে।
মৃত্যুর বড় ধরনের পর্যালোচনা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ মিশন। যৌথ মিশনের সদস্যরা ১৬ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি চীনের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছিল। যৌথ মিশন ওই সময় ৫৫ হাজার ৯২৪ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে। তাঁদের মধ্যে ২ হাজার ১১৪ রোগী মারা যান। মৃতদের ২১.৯ শতাংশের বয়স ছিল ৮০ বছরের বেশি। পেশার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অবসরে যাওয়া বেশি মানুষ মারা গেছেন, এঁদের হার ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। করোনা ছাড়া অন্য কোনো রোগ ছিল না এমন মানুষের মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু দেখা গেছে, আগে অন্য রোগ থাকা মানুষের করোনা হওয়ার পর মৃত্যুহার বেশি। তাতে দেখা যায়, হৃদ্রোগ ছিল ১৩ দশমিক ২ শতাংশের, ডায়াবেটিস ৯ দশমিক ২ শতাংশের, উচ্চ রক্তচাপ ৮ দশমিক ৪ শতাংশের, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট ৮ শতাংশের এবং ক্যানসার ৭ দশমিক ৬ শতাংশের।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে যৌথ মিশনের এই প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর বিশ্ববাসী জানতে পারে, কোন ধরনের মানুষের করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের পরিস্থিতি আরও পরিষ্কার করে জানা ও বোঝার জন্য নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, একটি হাসপাতালে করোনা নিয়ে ভর্তি হওয়া ১০ জন রোগীর মৃত্যু হতে পারে। ৩ জনের মৃত্যু হয়তো হৃদ্রোগের কারণে, ৩ জন হয়তো তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণে মারা গেল। বাকি ৪ জনের কারণ হয়তো ততটা স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে মারা যাওয়া কিছু রোগীর তথ্য নিয়ে কাজটি শুরু করা দরকার।
অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, গত প্রায় এক মাসের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, হাসপাতালে বিলম্বে আসা রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার পর তাঁরা হাসপাতালে পৌঁছাচ্ছেন। ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তবে এ বিষয়ে জাতীয়ভাবে তথ্য থাকলে মানুষকে সচেতন করার এবং সঠিক বার্তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হতো।
বৈশ্বিকভাবে বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। বাংলাদেশেও তাই। তবে বাংলাদেশে কম বয়সীদেরও মৃত্যু হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ১০ বা ২০টি তরুণ বয়সীদের মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করলে একটা কারণ হয়তো বের হয়ে আসতে পারে। শুধু গবেষণার স্বার্থে নয়, চিকিৎসার জন্যও কারণগুলো জানা দরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়া ও মারা যাওয়া রোগীদের একটি বিশ্লেষণের কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ওই বিশ্লেষণ থেকে কিছু বিষয় হয়তো আমরা দেশবাসীকে তথা নীতিনির্ধারকদের জানাতে পারব।’
অন্যদিকে ৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত করোনার উপসর্গ নিয়ে ৯০০টি মৃত্যুর পর্যালোচনা করেছেন১১ জন তরুণ গবেষক ও শিক্ষার্থী। তাঁদের এ গবেষণা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল না। প্রথম আলোসহ ২৫টি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর ঘটনা তাঁরা পর্যালোচনা করেছেন। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৯০০–এর মধ্যে ২২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বাড়িতে। বাড়ি বলতে নিজের বাসা, শ্বশুরের বাসা, বাবা বা মায়ের বাসা, ছেলে বা মেয়ের বাড়ি, ভাড়া বাসা বা কর্মস্থলে থাকার জায়গায়। এসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ২/৩ দিন, ৭ দিন বা ১০ দিন সর্দিজ্বরে ভুগেছেন এবং একপর্যায়ে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা গেছেন।এঁদের মধ্যে ১৫২ জন বা ৬৬ শতাংশ প্রায় বিনা চিকিৎসায় বা চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই মারা গেছেন। ১৩ শতাংশ স্থানীয় চিকিৎসক, পল্লিচিকিৎসক, কবিরাজ, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, তান্ত্রিকের কাছে গেছেন বা নিজে নিজে সর্দি বা জ্বরের ওষুধ খেয়েছেন কিংবা ওষুধের দোকানির পরামর্শ নিয়েছেন। ১২ শতাংশকে উপজেলা, জেলা বা সরকারনির্ধারিত করোনা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ৭ শতাংশ মারা গেছেন হোম কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) থাকা অবস্থায়। আর ২ শতাংশ মারা গেছেন হাসপাতাল অপারগতা প্রকাশ করার পর বাসায় থাকা অবস্থায়।
গবেষক দলের প্রধান ও নেদারল্যান্ডসের গ্রনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী অনুপম সৈকত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে উদ্যোগ নিলে কিছু মৃত্যু এড়ানো সম্ভব বলে মনে করি।’
দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন ৮ মার্চ। গত তিন মাসে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেকটাই উদ্দেশ্যহীনভাবে কাজ করেছে। কাজে যেমন পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল, তেমনি ছিল সমন্বয়হীনতা। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে নানা অভিযোগ গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য মানুষকে সুস্থ করে তোলা, মৃত্যু থেকে রক্ষা করা। মৃত্যুর সঠিক পর্যালোচনা হলে কাজটি সহজ হবে।