করোনাভাইরাস কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন মন্ত্রিসভার সদস্য, সাংসদসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও। এত দিন চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হচ্ছিলেন। কিন্তু এখন বিশিষ্টজনদের আক্রান্ত হওয়া এবং কারও কারও মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। নিজের ও পরিবারের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা।
সবশেষ সরকারের দুজন সচিব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতিরক্ষাসচিব আবদুল্লাহ আল মহসিন চৌধুরী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর ও তাঁর স্ত্রী নাসরীন আক্তারও করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মাইদুল ইসলাম গতকাল রোববার প্রথম আলোকে এই তথ্য জানান। এই কর্মকর্তা নিজেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এখন সুস্থ হয়ে বাসায় আছেন।
করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এই সময়ে বন্ধ ছিল গণপরিবহন, অফিস-আদালত। ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে সব চালু হলেও এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সরকার এখন এলাকাভিত্তিক লকডাউনের কথা ভাবছে। ইতিমধ্যে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউন চলছে। কিন্তু সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি নেই। উল্টো আক্রান্তের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় এখন বাংলাদেশ। গত ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরের ৯৯ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৫২০। আর প্রতিবেশী ভারতে ১০০ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৫৯ হাজার ৬৬২ জন। যত দিন যাচ্ছে, সংক্রমণ ততই বাড়ছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, সংক্রমণ শুরুর প্রথম ১০০ দিনে ভারত ও পাকিস্তানে যে পরিমাণে মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
মন্ত্রিসভার সদস্য ও সাংসদদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর, যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের সাংসদ রণজিত কুমার রায়, নওগাঁ-২ আসনের সাংসদ শহীদুজ্জামান সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সাংসদ এবাদুল করিম, জামালপুর-২ আসনের সাংসদ ফরিদুল হক খান, চট্টগ্রাম-১৬ আসনের সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। তাঁদের মধ্যে নওগাঁর শহীদুজ্জামান সরকার ইতিমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।
গত রোববার মারা গেলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাংসদ মোহাম্মাদ নাসিম এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। এর আগে করোনায় মারা গেছেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির, সংরক্ষিত মহিলা (বগুড়া-জয়পুরহাট) আসনের সাবেক সাংসদ কামরুন্নাহার ও সাবেক সাংসদ হাজি মকবুল হোসেন।
>এখন পর্যন্ত সরকারের তিনজন মন্ত্রী ও সাত সাংসদ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন এক মন্ত্রী ও এক সাংসদ।
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে মারা গেছেন সাবেক সচিব এম বজলুল করিম, অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়া অতিরিক্ত সচিব তৌফিকুল আলম, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ফখরুল কবির, উপকর কমিশনার সুধাংশু কুমার, রাজস্ব কর্মকর্তা খোরশেদ আলম, খাদ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা উৎপল হাসান, দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান প্রমুখ।
গত শনিবার দিবাগত রাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নতুন সচিব আবদুল মান্নানের স্ত্রী কামরুন নাহার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনায় মারা গেছেন সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর স্ত্রী বেগম সাহান আরা আবদুল্লাহ।
শিক্ষাবিদদের মধ্যে মারা গেছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলুফার মঞ্জুরসহ কয়েকজন। এ ছাড়া করোনার কাছে হার মেনেছেন ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য নাজমুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাকিল উদ্দিন আহমেদ।
এ ছাড়া পানি বিশেষজ্ঞ এম এ সামাদ, এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম, পপুলার গ্রুপের চেয়ারম্যান তাহেরা আক্তার, নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী খোকন সাহা, ব্র্যাকের পরিচালক আফতাব উদ্দীন আহমদ, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা মো. ইমামুল কবীর প্রমুখ মারা গেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম ব্যবস্থাপক আশরাফ আলী, রূপালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক সহিদুল ইসলাম খান, সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার মাহবুব এলাহী, সিটি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের মুজতবা শাহরিয়ার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদসহ বেশ কয়েকজন ব্যাংকার মারা গেছেন।
বিভিন্ন বাহিনীতে আক্রান্তের অবস্থা
সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে এ পর্যন্ত ১১ হাজার ২৪৭ জন সদস্য ও তাঁদের পরিবারের লোকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পুলিশ বাহিনীতে। গতকাল রোববার পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৩১৭ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদস্য আছেন ১ হাজার ৯৪৯। এ পর্যন্ত পুলিশের ২৪ জন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, গতকাল পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) আছেন ৯ হাজার ৩৯৬ পুলিশ সদস্য। আর আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) ৩ হাজার ২১৮ জন। আক্রান্ত সদস্যদের মধ্যে ৩ হাজার ৭৩০ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে জানান, আক্রান্ত সদস্যদের চিকিৎসার জন্য রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল ছাড়াও একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভাড়া করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য ১১টি হোটেলও ভাড়া করা হয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনী সূত্র জানায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু থেকে এ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্য এবং তাঁদের পরিবার মিলে ৩ হাজার ৪৭৭ আক্রান্ত হয়েছেন। আর মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। এ সময় সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৩৮ জন।
সূত্র জানায়, আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২ হাজার ৫৭ জন তিন বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সদস্য, ১৮৮ জন তাঁদের পরিবারের সদস্য। আর বাকিরা সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনবল।
করোনায় মারা যাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ৮ জন অবসরপ্রাপ্ত, যাঁদের বয়স সত্তরোর্ধ্ব। কর্মরত দুই সেনাসদস্যই অনিরাময়যোগ্য বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল পর্যন্ত আনসারের ৪৫২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৮৭ জন সুস্থ হয়েছেন। আনসারে আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকায় কর্মরত সদস্য আছেন ৩৭৭ জন। বাকিরা ঢাকার বাইরের সদস্য। আক্রান্তের তালিকায় একজন পরিচালকও আছেন। আনসারে দুজন সদস্য করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
এর বাইরে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একজন সদস্য।