কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে এই সপ্তাহের শুক্রবার জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়নি। এই অঞ্চলের প্রবীণ ও মধ্যবয়সীরা বলছেন, স্মরণকালে যুদ্ধাবস্থায়ও এই অঞ্চলে তাঁরা এমন নিস্তব্ধ সময় পার করেননি।
কাতার কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘আমরা ২০১৭ সালে প্রতিবেশী দেশগুলোর আকস্মিক চাপিয়ে দেওয়া অবরোধের দুঃসময় মোকাবিলা করতে পেরেছি, বর্তমানের এই সাময়িক দুর্যোগও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাটিয়ে উঠব।’
এই অঞ্চলে ইরানের পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কাতার। ২০ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এদিন নতুন করে আরও ১০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৭০। এ পর্যন্ত কাতারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছে ১০ জন। আর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৯ হাজারের বেশি মানুষের।
প্রতিদিন বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা। ফলে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য বিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাতে কাতারজুড়ে প্রতিনিয়ত নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ১৮ মার্চ থেকে কাতারে কেবল কাতারের নাগরিক ছাড়া সবার প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পণ্যবাহী ও ট্রানজিটের ফ্লাইট আগমন অব্যাহত রয়েছে।
কাতারজুড়ে কয়েক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, আদালত, পাবলিক পরিবহন, সব পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র, হাটবাজার, শপিং মল, সিনেমা হল, নাট্যশালা, ব্যায়ামাগারসহ নানা স্থাপনা। তবে ওষুধ ও প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দোকান খোলা থাকবে। এ ছাড়া বাসায় বসে দাপ্তরিক কাজ করার নিয়ম কার্যকর করা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। পাশাপাশি ২২ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় শুরু হচ্ছে ঘরে বসে পাঠদান। সে জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের কম্পিউটার বা ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তাদের নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে কাতার চ্যারিটি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
সর্বশেষ এক সরকারি আদেশে ২২ মার্চ থেকে সব সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০ ভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর উপস্থিতি রেখে বাকি ৮০ ভাগকে ঘরে বসে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। বিভিন্ন আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নগদ অর্থের পরিবর্তে কার্ড দিয়ে লেনদেনের আহ্বান জানানো হচ্ছে। ১৫ মার্চ থেকে কাতারজুড়ে সব রেস্তোরাঁ ও কফি শপে বসে খাওয়াদাওয়া নিষিদ্ধ করে কেবল বাইরে অর্ডার সরবরাহের সুযোগ রাখা হয়েছে।
কাতারে করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জনসাধারণকে জানানোর আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা–সম্পর্কিত সর্বোচ্চ কমিটি বৈঠক করে। কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ খালেদ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। কমিটির মুখপাত্র লুলুয়া বিনতে খাতের প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানান।
বিদেশ থেকে সদ্য ফেরত কাতারের নাগরিকদের কাতারজুড়ে বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটেলে বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি যেসব এলাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে পাওয়া গেছে, সেই এলাকা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে।
কাতারের শিল্পাঞ্চল সানাইয়ার কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ১৭ মার্চ থেকে সানাইয়ার পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে প্রতিটি প্রবেশ ও বহির্গমন পথে পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে। দুই সপ্তাহের জন্য এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় সংবাদমাধ্যমে। ফলে সানাইয়া এখন দেশের অন্যান্য অংশ থেকে এখন এক রকম বিচ্ছিন্ন।
কাতারের এই বিচ্ছিন্ন নগরীতে বাংলাদেশিসহ বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বসবাস করেন। তাঁদের বেশ কয়েকজন জানান, সরকারিভাবে সেখানে চাল, ডাল, তেলসহ প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। যেসব শ্রমিক এ অবস্থায় কাজে যেতে পারছেন না, মাস শেষে তাঁরা সবাই পুরো মাসের বেতন পাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন শ্রম মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
২০ মার্চ থেকে কাতারজুড়ে সব ধরনের ফল, শাকসবজি ও তরকারির কাঁচা পণ্য এবং মাছের দাম বেঁধে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে স্যানিটাইজারের দামও বেঁধে দেওয়া হয়। কাতারের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন ভবন, আবাসিক হোটেল ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা তাঁদের নিজস্ব স্থাপনায় বিনা মূল্যে সেবা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে কাতারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীদের জন্য নানা সুবিধা ও ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত ভাড়া না নেওয়ার ঘোষণা, পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওকুফসহ নানা সহায়তামূলক ব্যবস্থা। পাশাপাশি কাতারে আমদানি করা মেডিকেল ও খাদ্যপণ্যে কোনো রকম শুল্ক না নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।
কাতার ফাউন্ডেশন, সাংস্কৃতিক নগরী কাতারা, মুশায়রিব, বারওয়া, হাছাদ, কাতারের দিয়ার, মানাতেকসহ বড় বড় রাষ্ট্রীয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের এমন ঘোষণায় কিছুটা হলেও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
কাতার ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করেছে।
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক বৈঠকে বেসরকারি খাতের সহায়তায় ৭৫ বিলিয়ন রিয়ালের আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সব ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার ভাড়া ও বিল মওকুফের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।
কাতারে সবাইকে নিজ নিজ ঘরে অবস্থানের জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। ঘরবন্দী এই সময়টুকুকে আনন্দময় করে রাখতে বাড়তি মূল্য ছাড়া ইন্টারনেট গতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে অনলাইনে প্রতিযোগিতার আয়োজন চলছে।
কাতারে বিপুলসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিকও সরকারি তত্ত্বাবধানে কোয়ারেন্টিনে আছেন। আছেন অনেক বাংলাদেশিও। তবে ভবিষ্যতে যেকোনো সংখ্যক আক্রান্তের জন্য নিরাপদ কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে আলখোরসহ দূরবর্তী এলাকায় অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প নির্মাণ করছে সরকার।
৭ মার্চ থেকে কোয়ারেন্টিনে থাকা বাংলাদেশি কর্মী সায়মন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবজি মার্কেট এলাকা থেকে আমিসহ ৩০-৪০ জন বাংলাদেশিকে চেকআপের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের মধ্যে একজনের তাপমাত্রা বেশি থাকায় সতর্কতামূলক আমাদেরও কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।’
সায়মন বলেন, ‘আমাদের জন্য প্রতিদিন তিন বেলা ভালো মানের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া তোয়ালে, প্যান্ট, টুথপেস্টসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন দুই দফা তাপমাত্রা চেক করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রতি রুমে একজন করে দুই তলায় মোট আটজন থাকেন এক ভবনে। এমন অনেকগুলো ভবনে প্রায় দেড় হাজারের মতো বাংলাদেশি কর্মী আছেন।’
১৯ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ কমিটির মুখপাত্র লুলুয়া বলেন, ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এরপরও কাতারের নাগরিক ও অভিবাসীদের একটাই চাওয়া, সব প্রতিকূলতা মেনে নিয়েও সবাই সুস্থ থাকুক।
পৃথিবীর কোটি মানুষের কাছে এই মুহূর্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেয়ে মূল্যবান আর কোনো স্বপ্ন নেই। কয়েক দিন আগেও কি মানুষ এমন অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে পড়ার মতো দুঃস্বপ্নের কথা ভেবেছিল!