করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সৃষ্ট অচলাবস্থায় আয় রোজাগার কমেছে দেশের মানুষের। অসহায় নিম্নবিত্তের পাশে সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অনেকে। কিন্তু সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি অর্থকষ্টে থাকলেও পারিপার্শ্বিক লোকলজ্জার ভয়ে সহযোগিতা চাইতে পারে না। এ দুর্দশায় এ শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করে তাদের গোপনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন পুলিশের সদস্যরা। এটি নগর পুলিশের নিজস্ব উদ্যোগ, সরকারি প্রণোদনা নয়। পুলিশের সমাদৃত এ উদ্যোগ মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে।
দেশের এ সংকটে অনেক মানবিক দৃষ্টান্ত সামনে আসছে। তবে পুলিশের মানবিক উদ্যোগ ও নিরলস কাজ এই বাহিনীকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছে সাধারণ মানুষের কাছে।
কোভিড-১৯ নিয়ে আতঙ্কে মানুষ। আর সব ভয় অতিক্রম করে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। প্রয়োজনে ঝুঁকিও নিতে হচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী লোকজনের দাফনের দায়িত্বটুকু পড়েছে পুলিশের কাঁধে। শুধু তা-ই নয়, বিদেশফেরত লোকজনের হাতে কোয়ারেন্টিনের তারিখসমৃদ্ধ সিল বসানোর ঝুঁকি নিয়েছিল পুলিশ। দেশে সৃষ্ট এ অচলাবস্থায় মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি মানবিক কাজেও এগিয়ে আসছেন এ বাহিনীর সদস্যরা।
নানা আলোচনা ছাপিয়ে গত কয়েক দিনে দেশের গণমাধ্যমে ইতিবাচক সব মানবিক কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন এ বাহিনীর সদস্যরা। বগুড়ার শিবগঞ্জে, রাজশাহীর বাগমারায়, শরীয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের দাফনে স্থানীয়দের বাধা অথবা অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ দাফন—এসব ঘটনা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় সমাধানে আসে। এর মধ্যে দুই কিলোমিটার দূরে দাফনেও বাধা এবং করোনা-আতঙ্কে আত্মীয়স্বজন ছাড়াই শেষকৃত্যের ঘটনাও রয়েছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস পরম আপনজনকে দূরে সরিয়ে দিলেও পাশে ছিল পুলিশ।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষের বাসায় বাজার পৌঁছে দিতে ‘ডোর টু ডোর শপ’ চালু করেছে। অসহায় মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, কোয়ারেন্টিন মানা প্রবাসীদের বাসায় উপহারস্বরূপ ফলমূল পৌঁছে দেওয়া বা স্বীকৃতি সনদ প্রদান, চিকিৎসক-নার্সদের কর্মস্থলে পৌঁছে দেওয়াসহ বেশ কিছু উদ্যোগে নিয়েছে। করোনা-আতঙ্কে চট্টগ্রামে পাঁচ মাস বয়সী এক শিশুকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে ওই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরেছে। অথচ এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনের কথা ছিল চিকিৎসক সমাজের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগ রেশন ও বেতনের টাকায় ছিন্নমূল দুস্থ মানুষকে খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোথাও কোথাও নিজের বেতনের অর্ধেক বা কিছু অংশ ব্যয়ে মানুষের সহায়তায় আসছেন পুলিশের সদস্যরা। দেশজুড়ে পুলিশের সব ভালো কাজের সংবাদ আসছে গণমাধ্যমে। আবার এ সংকটে নাগরিকদের দায়িত্বহীন আচরণের খবরও আসছে। চট্টগ্রামে কয়েকজন নাগরিক বাসায় বসে মাছ-আচার বানানোর পাঁচফোড়ন কিনে দেওয়ার জন্য পুলিশের হটলাইনে ফোনও করেছেন। তার পরও নিরবচ্ছিন্নভাবে পুলিশ সেবা দিয়ে যাচ্ছে, যেন পুলিশের মধ্যে ভালো কাজের এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে।
উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনী সৃষ্টির ইতিহাসই নেতিবাচক। পুলিশের সৃষ্টি হয়েছিল আতঙ্ক-ভীতি সৃষ্টির জন্য; দমানোর অস্ত্র হিসেবে, যা ছিল ইংরেজ শাসকদের সহযোগিতার ‘লাঠিয়াল বাহিনী’। ১৮৬১ সালের সেই পুরোনো আইন দিয়ে চলছে দেশের পুলিশ। সেই থেকে এ বাহিনী সব সময় নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়ে আসছে। নাটক-সিনেমায় পুলিশকে ‘জনবিরোধী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এর জন্য বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটও দায়ী। আমরা দেখেছি, ছোট বাচ্চাদের ভয় দেখাতে পুলিশের ভয়ংকর রূপ হাজির করেন মায়েরা।
এসব নেতিবাচক চরিত্রে উপস্থাপিত হওয়ার অন্যতম কারণ পুলিশের সেই ব্রিটিশ আমলের চরিত্র থেকে বের হতে না পারা। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসা রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে ব্যবহার করেছে ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে।
বছর কয়েক ধরে নেতিবাচক খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। দূরত্ব ঘোচাতে ‘পুলিশ জনতা, জনতাই পুলিশ’ প্রতিপাদ্যে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছিল। এটি সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূলে সমাজের মানুষের সহায়তায় ‘অংশীদারত্বমূলক পুলিশিং কার্যক্রম’ প্রতিষ্ঠার ধারণা। অর্থাৎ সমাজের নাগরিকেরা অপরাধ নির্মূলে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তার পাশাপাশি নিজেরাই ছোট সমস্যার সমাধান করবেন। এর ফলে জনগণের তুলনায় পুলিশের সংখ্যাত্মক সংকট দূর হবে। মূলত ধারণাটি উত্তরের দেশ অর্থাৎ উন্নত বিশ্ব থেকে ধার করা। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের সমাজে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ধারণা বাস্তাবায়নে বাধা হিসেবে সামনে আসছে উন্নত বিশ্বের আর্থসামাজিক অবস্থার পার্থক্য। তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হলো, বাংলাদেশের মানুষের কল্পিত-অঙ্কিত ‘পুলিশের নেতিবাচক চরিত্র’। জনসাধারণের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব হ্রাস, আস্থার সম্পর্ক তৈরি ছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং ধারণাটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
দেশের এই সংকটে পুলিশের নিরলস দায়িত্ব পালন এবং মানবিক কাজে এগিয়ে আসা জনগণের সঙ্গে দূরত্ব হ্রাস ও আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। পুলিশভীতি দূর হচ্ছে বলেই সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। ভরসা করছেন মানুষ, পুলিশের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে দেওয়া অনুরোধ আসছে। গাড়ি করে গর্ভবতী নারী, রোগী, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হাসপাতালে বা কর্মস্থলে পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। এ সময়ে জনগণের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছে পুলিশ। দীর্ঘস্থায়ী আস্থার সংকট দূর করে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এখনই সময়। পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দীর্ঘদিনের আস্থার সংকট দূরীকরণে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সংস্থাটির নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন এখন। পুলিশের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক, যা ভবিষ্যৎ পুলিশের জন্য নতুন চরিত্র সৃষ্টি করবে এ সমাজে।
লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম বিষয়ে গবেষণা সহকারী