‘এই মাআআআছ, দেশি মাআআছ’, ‘মুগরিইই লাগে মুরগিই’, ‘লাগে ছাইইই’। প্রতিদিনের জীবনযাপনে এগুলো শহরবাসীর কাছে খুব পরিচিত হাঁকডাক। চেনা কণ্ঠস্বরের এই ডাকে মুখরিত হয় প্রতিদিনের শহুরে সকাল। কিন্তু করোনাকালে ফেরিওয়ালাদের এই পরিচিত হাঁকডাকে যোগ হয়েছে অনেক অপরিচিত কণ্ঠস্বর। খেয়াল করলেই দেখা যায়, সুর-তাল-লয়-ছন্দে একেবারে অনভিজ্ঞ ও আনকোরা কিছু মানুষ রাস্তায় নেমেছে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করতে। এই নতুন মানুষ কারা? খোঁজাখুঁজি করতে জানা গেল এক নতুন তথ্য। করোনাকালের বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে নিম্নবিত্ত অনেক পরিবারের হাল ধরেছেন কিশোর কিংবা সদ্য তরুণ সদস্যরা।
গত এক মাসে এ রকমই কিছু কিশোরের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের দেখা হয়েছিল ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায়। কথা হয়েছিল কারও কারও সঙ্গে। কেউ কেউ এড়িয়ে গেছে নিজেদের পরিচয় কিংবা পরিবারের কথা।
দুই বন্ধুর গল্প
বর্ষার কাল। যখন বৃষ্টি ঝরে তখন চরাচর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর যখন বৃষ্টি নেই তখন তপ্ত রোদে তেতে ওঠে ঢাকা শহর। প্রখর রোদে রাস্তার পিচও প্রায় গলে যাওয়ার জোগাড়। বরাবরের মতো সকালগুলো শুরু হয় ফেরিওয়ালাদের ডাকে। বেশ একটু বেসুরো ডাক শুনে বাসার নিচে গেলাম। ব্রয়লার মুরগির ভ্যান এসেছে। রাস্তার পাশের ব্রয়লার মুরগির দোকানগুলো এখন বন্ধ। বাসার নিচে মুরগির ভ্যান, তাই অভিজ্ঞ সংসারী মানুষজন বেশ দরদাম করছেন। দাম চাইতে বারবার কিছুটা থতমত খেয়ে যাচ্ছে নাদিম ও তার বন্ধু। নাদিমের বয়স ১৮ হয়নি এখনো। গতবার এসএসসি পাস করেছে। তার বন্ধুও একই বয়সী। দুজনই থাকে জেনেভা ক্যাম্পে। জিজ্ঞেস করলাম, কত দিন সে এই কাজ করছে। বলল, এক মাসও হয়নি। জানতে চাইলাম, আগে কী করত? বলল, কিছু না। তার বাবা কাজ করতেন তৈরি পোশাক কারখানায়। করোনা শুরু হওয়ার পর চাকরি চলে গেছে। ফলে নাদিমের হাতখরচের টাকা বন্ধ হয়ে গেছে। হাতখরচের টাকা আর সঙ্গে যদি কিছু বেশি রোজগার হয় সেটা দিয়ে সংসারে সহায়তা করার জন্য দুই বন্ধু মিলে বাড়ি থেকে কিছু করে টাকা নিয়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রির কাজ করছে। নাদিমের বন্ধুর নাম ওসমান।
কথায় কথায় নাদিম জানাল, করোনার আগের জীবনে সে ছিল একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। করোনাকালে সবাই যখন ছিটকে পড়েছে বিভিন্ন দিকে, তখন রাজনৈতিক দলটির অফিসে পড়েছে তালা। ফলে বাড়িতে থাকতে হয়। ফলে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের জন্য যুদ্ধ শুরু করেছে। দুজনেই বেশ লাজুক। ছবি তুলতে চাইলে প্রথমে আপত্তি জানলেও ছবি তুলল। দিনে নাদিম ও ওসমান হাজারখানেক টাকা রোজগার করে মুরগি বিক্রি করে। বলল, হাতখরচের টাকা উঠেও বেশ অনেক টাকাই থাকে হাতে। বাড়ি থেকে নেওয়া টাকা দুজনেই ফিরিয়ে দিয়েছ। এখন লাভের সময় চলছে নাদিম আর ওসমানের।
রবিউলের খেলনা
রোদ-বৃষ্টি যেন চোর–পুলিশ খেলছে এ শহরে। এই রোদ এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় যখন ঘুরছি, তখন মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে দেখা হলো এক খেলনা বিক্রেতার সঙ্গে। ভরদুপুরে ১২ নম্বর গোলচত্বরের একটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বাদাম খাচ্ছিল সে। চোখাচোখি হতেই সলজ্জ হাসি। দাঁড়ালাম তার ভ্যানের পাশে। নাম রবিউল, বয়স ১৭, বাবার নাম আলাউদ্দিন। গ্রামের বাড়ি সাভাররের খাগুড়িয়া। মিরপুরের বাঙলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে রবিউল। বাবার হাঁটুর রোগ, তাই বেশি হাঁটতে পারেন না। ফলে তাঁর খেলনা বিক্রির ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রবিউল। এখন কলেজ বন্ধ, তাই সারা দিন ভ্যান ঠেলে খেলনা বিক্রির চেষ্টা করে।
রবিউলের ফরসা মুখ রোদে ইষৎ লাল হয়ে আছে। জানাল, যখন সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে তখন থেকে স্কুলের পর এক বেলা বাবার খেলনা বিক্রির রিকশা ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। যা বিক্রি হতো তা নিয়ে বাড়ি ফিরে জমা দিত বাবাকে। এভাবেই চলছিল। কিন্তু করোনাকালের আগে হঠাৎ তার বাবা আলাউদ্দিনের হাঁটুর রোগ বেড়ে যায়। তার ওপর লকডাউন। কয়েক দিনের মধ্যে জমানো টাকা শেষ। কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে পুরো পরিবারকে। রবিউল ভ্যান নিয়ে হাঁটতে থাকে। আমি তার পাশে পাশে হাঁটি। নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলি, ভিডিও করি। রবিউল হাসে। একবার বলে, এখন তো তাও পাঁচ-সাত শ টাকা বিক্রি হয়। একসময় মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে পারত না। কিনতেও পারত না। তারপরও আশায় বুক বেঁধে বের হতো রাস্তায়। কোনো দিন শ খানেক, কোনো দিন একেবারে রিক্ত হাতে বাড়ি ফিরত। অসম্ভব কষ্ট গেছে পরিবারের চারজন মানুষের। রবিউল একটি প্লাস্টিকের খেলনা গাড়ি নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, ‘পঞ্চাশ টাকায় চারজনের কী হয় স্যার?’ নাহ, সে হিসাব করা হয়নি কোনো দিন।
ভরদুপুরে বাড়ির পথেই চলেছে রবিউল, ঢাকা উদ্যানের দিকের কোনো একটি বস্তিতে। যাওয়ার সময় ভুভুজেলার বিকট আওয়াজে দুপুরের বিষণ্ন রোদের গায়ে তরঙ্গ তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে সম্ভাব্য ক্রেতাদের। কেউ তেমন সাড়া দেয় না। সে রোদ মাথায় নিয়ে রাজপথে হাঁটতে থাকে।
এই স্বপ্নময় কিশোরদের স্বপ্নের গল্পগুলো ধরা থাক। ধরা থাক অতিমারির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিশোরদের স্বপ্ন দেখার গল্পগুলো—‘যদি দু-একটা বীজ ভিজে ওঠে’ কোনো দিন!
থেমে থাকেননি নাহিদ
নাহিদ, বয়স ১৮। উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। একটি জনপ্রিয় খাদ্য বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতেন। করোনায় সে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রেখেছে। ফলে মাসান্তে নিশ্চিত প্রায় ১২ হাজার টাকা উপার্জন বন্ধ। ছোট ভাই পড়ে মাদ্রাসায়। তার পড়ালেখা কি বন্ধ হয়ে যাবে? নাহিদ নেমে পড়েছেন বিকল্প কাজে। খাদ্য বিতরণের কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর, পরিচিতিও আছে খানিক। সে অভিজ্ঞতা আর পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে নেমে পড়েছেন মৌসুমি ফল পৌঁছে দেওয়া কিংবা দিন চুক্তিতে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের পক্ষে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ছোটখাটো কাজে।
নাহিদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাজমহল রোডের একটি বন্ধ রেস্তোরাঁয়। সেখানে তিনি আম পৌঁছে দেওয়ার একটা অর্ডার পেয়েছিলেন। প্লাস্টিকের ক্রেটের পর ক্রেট আম তিনি তুলছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। প্রতিটি ঠিকানা এবং ফোন নম্বর বুঝে নিয়ে যখন তিনি রওনা দেবেন গন্তব্যে তখন থামালাম তাঁকে। মিনিট পনেরোর আলাপ। বললেন, বাড়িতে আছেন মা, ছোট ভাইসহ আরও দুজন। চাকরি চলে গেছে। কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হবে, ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচও চালাতে হবে। তাই নেমে পড়েছেন রাস্তায়। সারা দিন কাজ করলে পান ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়েই আপাতত চলছে সংসার। করোনা গেলে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাববেন বলেও জানালেন নাহিদ। কিন্তু সেই সন্দিগ্ধ চেহারা। করোনা যাবে কবে? সবকিছু তো আর আগের মতো হবে না। তাহলে? এত কিছু ভাবতে পারেন না নাহিদ। আপাতত আজকের কাজ শেষ করতে হবে। তাহলেই পাবেন আজকের মজুরি। তিনি নিজের মুঠোফোন নম্বরটি দেন আমাকে। বলেন, কোনো কাজ থাকলে যেন ডাক দিই। আমি ওপর–নিচে মাথা নাড়িয়ে সায় দিই। নাহিদ উঠে বসেন সিএনজি অটোরিকশায়।
নতুন পথের দিশা
এসব অসম্ভব গল্প প্রতিদিন তৈরি হয় আমাদের শহরের পথে পথে। জনস্রোতে মিশে থাকা এসব গল্প নদীর প্রবাহের মতোই চলমান। আষাঢ়-শ্রাবণে এই গল্পের জীবনগুলোতে পাড় ভাঙার শব্দ পাওয়া যায়। আর আমরা, যাঁরা গল্পের পেছনে ঘুরি তাঁরা কখনোসখনো শুনতে পাই সে শব্দ। করোনাকালে জীবনযুদ্ধের কঠোর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে যাওয়া কিশোরদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিষণ্ন হয়ে ওঠে মন। ঘামে ভেজা দেহ আর করোনার বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় বর্ষার সোনালি রোদে। সে রোদ খানিক বেশিই
গায়ে লাগে।
না, তবু এগুলো কষ্টের গল্প নয়। জীবনের গল্প। অতিমারিতে তৈরি হওয়া এক প্রচণ্ড ইতিবাচক যাপনের গল্প। এই গল্পের কিশোরেরা করুণা চায়নি জীবনের কাছে কিংবা প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সর্বস্ব লুটে নেওয়ার প্রগাঢ় অন্ধকারের জীবন বেছে নেয়নি। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে পাথরে বানানো রাস্তায় হেঁটে হেঁটে জীবনকে জয় করার কথাই ভেবেছে।
করোনা শুরুর আগেও এই কিশোরেরা ছিল মুক্ত বিহঙ্গ। বাড়িতে খেয়ে স্কুল-কলেজে পড়ত, বাকি সময় কাটাত নিজেদের মতো আনন্দ করে। কেউ কেউ এক বেলা ছোটখাটো কাজ করে অল্পস্বল্প কিছু রোজগারও করত। তাতে নিজেদের চলে যেত। কিন্তু করোনা এসে সব এলোমেলো করে দিয়েছে। কোনো কোনো পরিবার পথে বসেছে। কোনো পরিবারের সবাই মিলে চেষ্টা করছেন বেঁচেবর্তে থাকতে। সে চেষ্টায় পরিবারের কিশোর সদস্যরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাস্তায় নামলেই দেখা মেলে এই কিশোরদের। এদের মধ্যে যারা খানিক লেখাপড়া করেছে তাদের কেউ ডেলিভারি বয়ের কাজ করছে কিংবা কিছুটা ভদ্রস্থ কাজ করার চেষ্টা করছে। আর যারা লেখাপড়া খুব একটা করতে পারেনি তারা হয়েছে ফেরিওয়ালা। মাছ, মুরগি, সবজিসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল, সুগন্ধি চাল ইত্যাদি বিক্রি করছে ফেরি করে।
ফ্রান্সে করোনায় কাজ হারানো তরুণদের যেসব প্রতিষ্ঠান চাকরি দিচ্ছে, দেশটির সরকার সেসব প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যম খবর এসেছে। নাদিম, ওসমান, রবিউল কিংবা নহিদের মতো শত শত কিশোর কিংবা উঠতি তরুণ পুরো ঢাকা শহরের অলিতে–গলিতে জীবন ঘষে আগুন জ্বালিয়ে চলেছে। এসব কিশোর-তরুণদের জন্য কোথাও কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই বলেই আমরা জানি। অথচ প্রতিদিনের অসম্ভব নেতিবাচক সংবাদের ভিড়েও নাদিম, ওসমান, রবিউল কিংবা নহিদেরা আনন্দ ধারার মতো প্রবহমান।