করোনা মহামারি

টিকা রাখার জায়গা খুঁজছে সরকার

ফাইল ছবি

হাম-রুবেলার টিকা দেওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশব্যাপী মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মবিরতির কারণে হাম-রুবেলার টিকা দিতে পারছে না তারা। টিকার মজুত পড়ে আছে। এরই মধ্যে করোনার টিকা কোথায়, কীভাবে রাখা হবে, তা নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। সরকার করোনার টিকা রাখার জন্য বিকল্প পথ খুঁজছে।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে একাধিকবার হাম-রুবেলা টিকা কর্মসূচি স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর থেকে ছয় সপ্তাহব্যাপী দেশব্যাপী এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। তাও স্থগিত হয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়েছে, ফেব্রুয়ারির মধ্যে টিকা দেওয়া শেষ না হলে করোনার টিকা সংরক্ষণে সমস্যা হবে।

স্বাস্থ্যের মাঠকর্মীদের প্রধান কাজের মধ্যে আছে: শিশুদের ১০টি রোগের টিকাদান, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মায়েদের টিকা দান, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া প্রতিরোধে কাজ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা দান। মহামারির সময় তাঁরা করোনার নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং কোয়ারেন্টিনে সহায়তা করেছেন। সারা দেশে স্বাস্থ্য সহকারী ও সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার।

বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতির দাবিতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় মাঠ কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিদর্শক সমিতির ডাকে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা ২৬ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি পালন করছেন। গতকাল শনিবার দেশব্যাপী হাম-রুবেলা টিকা কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল। স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীদের কর্মবিরতির কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্মসূচি স্থগিত করেছে। মাঠকর্মীদের কাজে ফিরে আসা নিশ্চিত না হলে হাম-রুবেলার টিকা দেওয়ার নতুন তারিখ ঘোষণা করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের দাবিগুলো যৌক্তিক। তাদের দাবি পূরণের জন্য আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলেছি। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুততম সময়ে তাদের কাজে ফিরিয়ে আনতে।’

হাম-রুবেলার টিকা

প্রকোপ কমে গেলেও দেশ থেকে হাম ও রুবেলা নির্মূল হয়ে যায়নি। ব্যাপক সংক্রমণ দেখা না দিলেও নিয়মিতভাবে হামের রোগী ভর্তি হয় রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে হঠাৎ হামের প্রকোপ দেখা দেয় এবং তাতে ১০টি শিশু মারা যায়।

হাম ভাইরাসজনিত রোগ। হাম হলে শিশু নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগে। আক্রান্ত হলে জ্বর, সর্দি, কাশির পাশাপাশি চোখ লাল হয়ে যায়। মুখে ও শরীরে লালচে দানা দেখা দেয়। রুবেলাও ভাইরাসজনিত ছোঁয়াচে রোগ। গর্ভবতী মায়েরা গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসের মধ্যে রুবেলায় আক্রান্ত হলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভের শিশু আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর মৃত্যু হতে পারে। রুবেলায় আক্রান্ত হলে গোলাপি রঙের দানা প্রথমে মুখে এবং পরে সারা শরীরে দেখা দেয়। জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা ও মাথাব্যথার পাশাপাশি ঘাড়ের গ্রন্থি ফুলে যায়।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে শিশুদের ৯ মাস ও ১৫ মাস বয়সে হাম-রুবেলার টিকা দেওয়া হয়। হাম-রুবেলার জন্য সর্বশেষ বিশেষ কর্মসূচি বা ক্যাম্পেইন হয়েছিল ২০১৪ সালে। এ বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ মার্চের মধ্যে দেশব্যাপী নতুন ক্যাম্পেইন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য সহকারীরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় সরকার সময় পিছিয়ে ১৮ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল টিকা কর্মসূচির নতুন তারিখ নির্ধারণ করে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা স্থগিত করা হয়।

প্রয়োজনে বিকল্প জনবল ব্যবহার করে টিকা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হবে।
আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ইপিআই সূত্র জানিয়েছে, সরকার গত বছর ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ ডোজ টিকা ও টিকাদান সামগ্রী কিনেছে। টিকা ও টিকাদান সামগ্রী সারা দেশে বিতরণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে এই টিকার মেয়াদ শেষ হবে।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি থেকে প্রথম আলোকে দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, এমআর (হাম-রুবেলা) টিকা আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে ব্যবহার করতে না পারলে ভবিষ্যতে করোনা টিকা এলে তা সংরক্ষণে সমস্যা হবে।

করোনার টিকা সরকার কখন সংগ্রহ করবে তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছেন না। তবে টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনে বিকল্প জনবল ব্যবহার করে টিকা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হবে।

কর্মবিরতি

বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় মাঠ কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আসাদুজ্জামান শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একই দাবিতে আমরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছি, আবেদন জানিয়ে আসছি। বারবার আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দাবি পূরণ করা হয়নি।’

স্বাস্থ্যের মাঠকর্মীদের প্রধান কাজের মধ্যে আছে: শিশুদের ১০টি রোগের টিকাদান, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মায়েদের টিকা দান, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া প্রতিরোধে কাজ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা দান। মহামারির সময় তাঁরা করোনার নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং কোয়ারেন্টিনে সহায়তা করেছেন। সারা দেশে স্বাস্থ্য সহকারী ও সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার।

স্বাস্থ্য মাঠকর্মীরা ১৬ গ্রেডের কর্মচারী। ৪১ বছর ধরে তাঁরা একই গ্রেডে আছেন। ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীদের সম্মেলনে সরকারের পক্ষ থেকে যাতায়াত ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, স্বাস্থ্য মাঠকর্মীরা ১৬ গ্রেডের কর্মচারী। ৪১ বছর ধরে তাঁরা একই গ্রেডে আছেন। ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীদের সম্মেলনে সরকারের পক্ষ থেকে যাতায়াত ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় মাঠ কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর। এরপর ২০১৮ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আন্দোলনের মুখে দাবি আদায়ের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাও বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারি মাসে একই ধরনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। নিরুপায় হয়ে তাঁরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে গেছেন।

শনিবার রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর সূত্র বলছে, আজ রোববার বা আগামীকাল দুই পক্ষের মধ্যে সভা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

জায়গার সংকট

হাম-রুবেলার টিকা দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছে গেছে গত জানুয়ারিতে। এ ছাড়া উপজেলাতে নিয়মিত টিকা কার্যক্রমের টিকাও মজুত আছে। এখন কর্মবিরতির কারণে এসব টিকার ব্যবহার হচ্ছে না। করোনার টিকা এলে কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও কিছুটা চিন্তিত।

শনিবার খুলনা জেলার দক্ষিণের একটি উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বিশেষ ব্যবস্থায় রাখতে হয়। যেখানে-সেখানে টিকা রাখা যায় না। করোনার টিকার ব্যাপারে প্রস্তুত থাকার কথা বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, করোনার টিকা এলে অন্য টিকা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

বাংলাদেশ করোনার টিকা বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করছে। খসড়া পরিকল্পনায় বলা আছে ২৬টি জেলায় করোনার টিকা রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। সরকার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের সংরক্ষণাগার ব্যবহারের কথা ভাবছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষণাগার ব্যবহার করা যাবে কি না, তাও খুঁজে দেখবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অন্য একটি জেলার সিভিল সার্জন প্রথম আলোকে বলেছেন, হাম-রুবেলার টিকা ব্যবহার করে ফেলতে না পারলে করোনা বা অন্য কোনো টিকা রাখার জায়গা হবে না। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো নির্দেশনা এখনো আসেনি।

শনিবার রাশিয়ার মানুষকে সে দেশের উদ্ভাবিত করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকার এই সপ্তাহে দেশের মানুষকে টিকা দেওয়া শুরু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ১০ বা ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে নতুন টিকা অনুমোদন দেওয়ার সম্ভাবনার কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি দেশ করোনার টিকা সংগ্রহ বা কেনা, টিকা সংরক্ষণ ও বিতরণ নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করছে।

মাঠপর্যায়ের রোগ প্রতিরোধ ও জনসচেতনতার মূল কাজ করেন স্বাস্থ্য মাঠকর্মীরা। তাঁদের দাবি যৌক্তিক হলে সরকারের তা মেনে নেওয়া উচিত। মহামারির সময়ে এ ধরনের অচলাবস্থা অনাকাঙ্ক্ষিত। খুব শিগগির সমঝোতায় পৌঁছানো উচিত।
অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন

বাংলাদেশও করোনার টিকা বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করছে। পরিকল্পনাটি খুব শিগগির চূড়ান্ত হবে বলে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। করোনার টিকা সংরক্ষণে জায়গার সংকটের কথা খসড়া পরিকল্পনায় উল্লেখ আছে। খসড়া পরিকল্পনায় বলা আছে ২৬টি জেলায় করোনার টিকা রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। সরকার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের সংরক্ষণাগার ব্যবহারের কথা ভাবছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষণাগার ব্যবহার করা যাবে কি না, তাও খুঁজে দেখবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ের রোগ প্রতিরোধ ও জনসচেতনতার মূল কাজ করেন স্বাস্থ্য মাঠকর্মীরা। তাঁদের দাবি যৌক্তিক হলে সরকারের তা মেনে নেওয়া উচিত। মহামারির সময়ে এ ধরনের অচলাবস্থা অনাকাঙ্ক্ষিত। খুব শিগগির সমঝোতায় পৌঁছানো উচিত।