সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকার বাইরে করোনা রোগী বাড়ছে। করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা অনেকটাই ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানীর বাইরে অনেক সেবা অপ্রতুল, কিছু ক্ষেত্রে সেবা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা চিকিৎসায় ঢাকার বাইরে মনোযোগ কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিসের কোনো ব্যবস্থা রাজধানীর বাইরে নেই। ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলার করোনা রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যা মাত্র সাতটি। ২০৫টি আইসিইউ শয্যা ঢাকা শহরে ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায়। করোনা রোগীর শয্যাসংখ্যাও অনেক জেলায় অপ্রতুল।
গতকাল পর্যন্ত দেশে ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৮৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৪৬ হাজার ৭৫৫ জন আর মারা গেছেন ১ হাজার ৫০২ জন। ৬৭ হাজার ৫২৯ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কত রোগী বাড়িতে আর কত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কিছু করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না, এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে হাসপাতালে শয্যা খালি থাকছে, এমন তথ্যও প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বয় ও নজরদারি বাড়ালে মানুষের দুর্ভোগ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালগুলোতে শয্যা সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। রোগীর পাশাপাশি মৃত্যুও বাড়ছে। মৃত্যু কমানোর সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে আছে, করোনার সময় তা নতুনভাবে দেখা যাচ্ছে।
কোভিড রোগীদের জন্য আর নতুন কোনো হাসপাতাল করা বা শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা আপাতত নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আশা করি, এতে ঢাকার বাইরের সমস্যাও দূর হবে।’
১১০ হাসপাতাল
সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ১১০টি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগে হাসপাতাল ২৬টি। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। এই বিভাগে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল ছয়টি।
এসব হাসপাতালের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মতো বড় হাসপাতাল যেমন আছে, তেমনি আছে ৫০ শয্যার বেশ কয়েকটি হাসপাতাল। বেশ কিছু ইনস্টিটিউটকে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবনেও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, এমন তথ্যও আছে।
রাজধানীতে ১৩টি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত। এর মধ্যে চারটি বেসরকারি হাসপাতাল। বেসরকারি এসব হাসপাতাল সরকারের সহায়তা নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছে। তবে আরও কিছু বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে বলে সরকারি ও বেসরকারি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
>
মহামারি নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে সংক্রমণ কমানো
দেশে করোনা চিকিৎসা-সংকটের সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান বলেন, রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে ১ হাজার ৫০০ শয্যার আইসোলেশন কেন্দ্র প্রস্তুতির কাজ খুব শিগগির শেষ হবে। এ ছাড়া বসুন্ধরা দুই হাজার শয্যার আইসোলেশন কেন্দ্র ব্যবহার পুরোপুরি শুরু হলে সমস্যা অনেক কমে যাবে।
কোথায় কত শয্যা
করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে শয্যা ১২ হাজার ৩৪টি। এর মধ্যে রাজধানী ও ঢাকা বিভাগে শয্যার সংখ্যা ৬ হাজার ৬৯৬টি। অর্থাৎ মোট শয্যার ৫৬ শতাংশ ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে। শয্যা সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে, ৪১৩টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় সব বিভাগেই প্রয়োজনের চেয়ে শয্যা কম। মাস দেড়েক আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি হাসপাতালবিষয়ক পরামর্শ তৈরি করার সময় বলেছিল, বরিশাল বিভাগের জন্য কমপক্ষে ৮৯৮টি শয্যা দরকার হবে। বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার জন্য তারা ৬ হাজার ৬১২টি শয্যার প্রস্তাব করেছিল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কোন কোন হাসপাতালে এসব শয্যা নির্দিষ্ট থাকবে, তা-ও কমিটি বলে দিয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই ৬টি বিভাগে ৪ হাজার ২০০ শয্যার ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ সুপারিশের চেয়ে ২ হাজার ৪১২টি শয্যা কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে কিছু পার্থক্য দেখা গেছে। যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ১৩টি করে হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত। এই দুই বিভাগে শয্যাসংখ্যা যথাক্রমে ৯২৪ ও ৭১৩। সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কার্যালয় প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে জানিয়েছে, রাজশাহী বিভাগে নির্ধারিত হাসপাতাল ১০টি এবং এতে শয্যাসংখ্যা ১ হাজার ৬২০টি। অন্যদিকে খুলনা বিভাগে হাসপাতাল ও শয্যাসংখ্যা যথাক্রমে ১২ ও ৭৪৩।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, রোগীর সেবার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে বড় কোনো ভুল এখনো হয়নি। জেলায় জেলায় আরও কিছু শয্যা হয়তো বাড়ানো যেত, অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়তো আরও কিছুটা উন্নত করা যেত। এখন লক্ষ রাখতে হবে সব রোগীর চিকিৎসা যেন নিশ্চিত করা যায়।
সংকট আইসিইউতে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৪০ শতাংশ রোগীর উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশ রোগীর। ১৫ শতাংশ রোগীর পরিস্থিতি মারাত্মক হয়। বাকি ৫ শতাংশ রোগীর অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে। সব মিলে প্রায় ৫ শতাংশ করোনা রোগীর আইসিইউ সেবা দরকার হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) কেউই কত রোগী আইসিইউ সেবা নিচ্ছেন বা কত রোগীর এই সেবার দরকার, তা নিয়ে কোনো তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না।
অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ১১০টা হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ৩৩৯টি। অ্যাডভাইজারি কমিটি বলেছিল, কমপক্ষে ৭২০টি (চট্টগ্রাম বিভাগের হিসাব ছাড়া) আইসিইউ শয্যা দরকার।
ময়মনসিংহ বিভাগে আইসিইউ সবচেয়ে কম। এই বিভাগের শুধু ময়মনসিংহ সদরের একটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য সাতটি শয্যা আছে। বাকি তিন জেলায় কোনো আইসিইউ সেবা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের ৪৯টি জেলায় করোনা রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। বিভাগীয় শহরগুলোতেই মূলত এই সেবার ব্যবস্থা আছে।
রাজধানী ঢাকায় ১৫৮টি ও ঢাকা বিভাগের ৬টি জেলায় ৪৭টি আইসিইউ শয্যা আছে করোনা রোগীদের জন্য। অর্থাৎ মোট আইসিইউ শয্যার ৬০ শতাংশ ঢাকার রোগীদের জন্য। দেশের বাকি রোগীদের জন্য ৪০ শতাংশ আইসিইউ।
অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, আইসিইউ সেবার জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি, আলাদা কক্ষ ও দক্ষ জনবল দরকার হয়। এই সেবায় অবেদনবিদের বড় ভূমিকা আছে। দেশে অবদেনবিদের সংকট করোনাকালের আগেও ছিল। তবে বসে থাকলে মৃত্যু কমানো যাবে না। সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
ডায়ালাইসিস শুধু ঢাকায়
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ডায়ালাইসিস দরকার হয়, এমন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি জটিল হয়। তাঁদের বিশেষ সেবার দরকার হয়। একজন রোগীকে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা ডায়ালাইসিস যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। এই সেবা নিয়মিত প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঢাকা শহরের বাইরে দেশের আর কোথাও করোনা রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস সেবা নেই।
রাজধানীর ৪টি সরকারি হাসপাতালে ১০১টি ডায়ালাইসিস যন্ত্র আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৫টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে ২টি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০টি, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ৩২টি এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৩২টি। এ ছাড়া বেসরকারি সাজেদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে একটি যন্ত্র আছে।
আন্তরিক হয়ে উদ্যোগ না নিলে এসব সমস্যা দূর হবে না। জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ বলেন, ‘জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবাকাঠামো দেশে গড়ে ওঠেনি। ভৌগোলিক বা অন্যভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে স্বাস্থ্যের পরিকল্পনা হতে দেখা যায় না। করোনা মোকাবিলায় পুরোনো সমস্যাকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন কিছু হয়তো করা যেত, কিন্তু করা হয়নি। তবে এখনো করার সময় শেষ হয়নি।’
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি)